• ঢাকা শনিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ পৌষ ১৪৩১
logo

নাহিদের হাত ধরেই ইউরোপে প্রথম বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট 

  ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৪১
ছবি: আরটিভি

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে ৯০ দশকে সুইডেনে পাড়ি জমান নাহিদ হাসান। এরপর জীবনে এসেছে নানা প্রতিকূলতা। তবুও হার মানেননি। বারবার বলেছেন, আমি পারবো। শেষ পর্যন্ত তিনি পেরেছেন। ইউরোপের বুকে লাল-সবুজের বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রথম বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট। যেখানে মেলে নিহারি থেকে বিরিয়ানি, সবই।

তবে তার পথচলাটা সুখকর ছিল না। শুরুতে এমনও হয়েছে তান্দুরির ওভেন চালানোর পয়সাটাও ছিল না তার পকেটে। আরটিভি অনলাইনকে শোনালেন সে গল্প।

নাহিদ হাসান বলেন, অন্যান্য দু-চারজনের মতো আমিও ইউরোপে এসেছিলাম পড়াশোনার জন্য। কিন্তু খরচে পেরে না ওঠায় একটি রেস্টুরেন্টে পার্টটাইম কাজ শুরু করি। ভেবেছিলাম অবস্থার একটু পরিবর্তন হলে ছেড়ে দেব। কিন্তু হলো উল্টোটা। দিনদিন আমার রান্নার প্রতি আগ্রহটা বাড়তে থাকল।

তিনি বলেন, ফ্যাশন ডিজাইনে পড়াকালে যখন আমি এই পার্টটাইম কাজটা শুরু করি, তখন স্টকহোমে মাত্র তিনটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ছিল। এর মধ্যে একদিন আমার এক ছোট ভাই বলল, টাকা জমিয়ে দুজনে মিলে একটা রেস্টুরেন্ট দিলে কেমন হয়? আমি বললাম, মন্দ হয় না। এরপর ইরাকে যুদ্ধকালে (২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে) সেই সুযোগ আসে। সস্তায় আমরা একটা রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাই। চিন্তা করলাম যুদ্ধ-বিগ্রহ যেহেতু ভালো লাগে না, সেহেতু রেস্টুরেন্টের নাম দিই ‘শান্তি’। ব্যস্, এভাবেই শুরু।

কিন্তু নাহিদের এরপরের গল্পটা মন খারাপের। কারণ, প্রথম ছয় মাস খুব খারাপ সময় পার করেছেন তিনি। কোনো কাস্টমারই পাননি। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী। যিনি তাকে সার্বক্ষণিক কাজে সহায়তার পাশাপাশি বারবার সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। পরে হলোও তাই।

সুইডেনের প্রভাবশালী একটি দৈনিক নাহিদের রেস্টুরেন্টের ইতিবাচক রিভিউ প্রকাশ করলো। এর পরদিন থেকেই বদলে গেল চিত্র। ভোজনরসিকদের ভিড় বাড়তে থাকল। সাফল্যের গল্পটা শুরু সেখান থেকেই।

এর ধারাবাহিকতায় নাহিদ হাসান খুললেন দ্বিতীয় রেস্টুরেন্ট, নাম ‘শান্তি সফট কর্নার’। খাবারের মান ও স্বাদ ভালো থাকায় এই রেস্টুরেন্টটাও সেখানকার মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করলো। নাম ছড়িয়ে যেতে থাকলো চারদিকে।

এ অবস্থায় একদিন লন্ডন থেকে কিছু লোক সেখানে খেতে আসেন। পরে খাবারের স্বাদ পরখ করে তারা বলেন, নাহিদ আপনার রান্না ভালো। লন্ডনে আসেন, আমরা রান্নার প্রতিযোগিতা করি। সেখানে আপনি অংশ নেবেন। তাদের কথা শুনে নাহিদ ভাবেন, রান্না দিয়েই একদিন তিনি দেশকে বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করবেন।

জার্নিটা এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে নাহিদ পিতৃত্বের স্বাদ পান, মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়। পরে একদিন তার মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে বলে, তার বান্ধবী জানিয়েছে, তোমরা বাংলাদেশি হয়েও কেন ইন্ডিয়ান নাম দিয়ে রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছো? বাংলাদেশি নাম কেন দিচ্ছো না?

মেয়ের বান্ধবীর কথাটা ভালো লেগে যায় নাহিদের। সিদ্ধান্ত নেন আর ইন্ডিয়ান নাম নয়, এখন থেকে বাংলা নামেই রেস্টুরেন্ট চালাবো। এরপর খুলে ফেলেন ‘টাচ অব বেঙ্গল’ নামে নিজ মালিকানার তৃতীয় রেস্টুরেন্ট।

বলে রাখা ভালো, এই ‘টাচ অব বেঙ্গল’-ই ইউরোপের প্রথম বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট। যার নাম ও মালিক দুই-ই বাংলাদেশি। এর আগে, সেখানে বাঙালি মালিকরা রেস্টুরেন্ট দিলেও চলেছেন ইন্ডিয়ান নাম দিয়ে।

সিজলার, ডাল, শাক-সবজি, পালক পনির, নিহারি, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ফিস ভুনাও পাওয়া যায় নাহিদের রেস্টুরেন্টে। আর সেসব মনভরে খান সেখানকার মানুষ। এতে তৃপ্তি পান নাহিদ।

আরটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, রান্না একটা আর্ট। ডাক্তার যেমন চান রোগীকে সেবা দিয়ে ভালো করতে, আমিও তেমনি চেয়েছিলাম কাস্টমারকে মজাদার খাবার উপহার উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করতে। কিন্তু এটা দিয়ে অনেক উপার্জন হবে, এমনটি কখনও ভাবিনি।

নাহিদ আরও বলেন, বিক্রি বাড়াতে কখনও কারও খাবারের মেন্যু কপি করিনি। নিজে যা পেরেছি, নিত্যনতুন খাবার মানুষকে উপহার দিয়েছি। এমনকি এখনও সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।

প্রথম তিনটি রেস্টুরেন্টের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় চতুর্থ রেস্টুরেন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেন নাহিদ হাসান। পরে ‘উলটিমথস’ নামে আরও একটি বাংলাদেশি খাবারের রেস্টুরেন্ট খোলেন। এরপর ‘গসিপ’ নামে শুরু করেন নিজের পঞ্চম রেস্টুরেন্ট। সেখানে ফুচকা, চটপটি, খিচুড়ি, গরুর মাংস, চাসহ মেলে রকমারি আরও সব স্ট্রিট ফুড।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর নাহিদকে পুরস্কৃত করেছেন। এ ছাড়া তিনবার পেয়েছেন লন্ডনের বেস্ট শেফের পুরস্কার। এর বাইরে ‘রেস্টুরেন্ট হিসেবে’ চারবার লন্ডনের এশিয়ান কারি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে তার মালিকানাধীন রেস্টুরেন্ট।

শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালেও পার্লামেন্ট থেকে নাহিদকে ‘বেস্ট শেফ ইন ইউরোপ’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ইউরোপের বিশিষ্টজনদের জন্যও রান্না করেন নাহিদ। গত দুই বছর আগে রান্না করেছেন সুইডেশ অ্যাম্বাসিতে। সেখানে চারশো ডিপ্লোম্যাটের খাবারের আয়োজন ছিল।

আলাপচারিতার ফাঁকে নাহিদ বলেন, আমার রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর, ডিপ্লোম্যাট সবাই-ই খায়। এ ছাড়া এ দেশের রাজা, রাজার ছেলে, ইন্ডিয়ান সেলিব্রেটিদের মধ্যে অনুপম খেরও এসেছেন, খেয়েছেন তৃপ্তিভরে।

তিনি বলেন, কাজ করতে করতে রান্না শিখলেও আরও কীভাবে ভালো করা যায়, সেই চেষ্টা আমার মধ্যে শুরু থেকেই ছিল। এ জন্য ১ বছর সুইডিশ কুকিংয়ের ওপর ক্লাসও করি।

অনেক সাহস করেই নিজের এগিয়ে যাওয়া উল্লেখ করে সফল এই উদ্যোক্তা বলেন, বাংলাদেশকে আগে সেভাবে কেউ চিনতো না। বাংলাদেশ বলতেই ইউরোপের মানুষ বুঝতো বন্যা আক্রান্ত ও দরিদ্র দেশ হিসেবেই। তারা যে ভালো কিছু, উদ্ভাবনী কিছু করতে পারে তা তারা চিন্তাই করতে পারতো না। তবে এখন সবাই বাংলাদেশকে ভালো চোখে দেখে।

দিনে দিনে ইউরোপে নিজের ব্যবসা বিস্তৃত করছেন নাহিদ। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি সেখানে তার ‘শান্তি’ নামে ওয়াইনও আছে। আছে একই নামে দুটো বেয়ারও।

রান্না নিয়ে এ পর্যন্ত নাহিদ সুইডেশ টিভিসহ বাংলাদেশি বিভিন্ন টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন নিজের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।

আরটিভি অনলাইনকেও শোনালেন সে গল্প। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমি একটি বই লিখেছি। যা সুইডিশ, জার্মানি ও হল্যান্ডের ভাষায় তিন দেশে বিক্রি হচ্ছে। আরেকটি বই লেখার কাজ চলছে। এ ছাড়া আমি কুকিং ক্লাসও করাচ্ছি। বাকিটা জীবন চাই এই সেক্টরে ভালো কিছু করতে। যাতে বাংলাদেশের নাম আরও উজ্জ্বল হয়।

দেশে ব্যবসার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ হাসান বলেন, ৩৫ বছর আমি দেশের বাইরে। তবুও চাই বাংলাদেশে আমার সিগনেচার ডিশ দিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট হোক। ভবিষ্যতে এটা করেও ফেলবো ইনশাআল্লাহ্। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

আরটিভি/আইএম/এআর

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পশ্চিমবঙ্গকে অস্থিতিশীল করতে বাংলাদেশিদের প্রবেশ করাচ্ছে বিএসএফ: মমতা
সীমান্তে নদীর পাড়ে মিলল বাংলাদেশির মরদেহ, শরীরে আঘাতের চিহ্ন
বাংলাদেশিদের জন্য থাইল্যান্ডের ই-ভিসা চালু
বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার (২ জানুয়ারি)