ঢাকাশুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা না পাওয়ায় সম্পত্তি বিক্রি করতে পারছেন না নসরুল হামিদ

আরটিভি নিউজ

বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫ , ১২:৪১ এএম


loading/img
ফাইল ছবি

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে পালিয়ে বেড়ানো আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা না পাওয়ায় সম্পত্তি বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। তবে, যেসব সম্পত্তি বিক্রি করেছেন, তার অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ক্লাবের ঠিক উল্টো পাশে ফাঁকা পড়ে আছে নসরুল হামিদ বিপুর এক বিঘার একটি ফাঁকা প্লট। এর বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী দাম অন্তত ২০০ কোটি টাকা। বিগত দুই মাস ধরে মূল্যবান এ সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করেও তিনি খুঁজে পাননি কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা। 

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের মূল্যবান প্লটের পাশাপাশি নসরুল হামিদের আরও রয়েছে পাঁচ বিঘা জমি। আর তা হলো- রাজধানীর মাদানী এভিনিউর ১০০ ফুট রাস্তার পাশে অবস্থিত। সেখানে তিনি বাগানবাড়ির আদলে এটা গড়ে তুলেছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেখানে তিনি নিয়মিত আড্ডা দিতেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এ ছাড়া, রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানেও তার সম্পত্তি ও ব্যবসা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নসরুল হামিদ সম্প্রতি মাদানী এভিনিউর জমিটিও বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন। এই জমিটি প্রতি কাঠা দুই কোটি করে ধরলেও সম্পত্তিটির মূল্য ২০০ কোটি টাকা। তবে এত বড় জায়গা একসঙ্গে কেনার মতো গ্রাহক না পাওয়ায় ছোট প্লট আকারে বিক্রির তৎপরতা চলছে। আর সেটি করছে নসরুল হামিদের কোম্পানি হামিদ রিয়েল এস্টেট।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, নসরুল হামিদ বড় আয়তনের এই দুটি প্লট বিক্রি করতে না পারলেও গুলশান, বনানী ও নিকেতন এলাকার একাধিক ছোট প্লট ও বাড়ি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি এসব সম্পত্তি বিক্রির টাকার বড় অংশই তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে গেছেন।  

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা পরিবারের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে কলকাতায় আছেন। 

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত দুই মাস ধরে নসরুল হামিদ আমাকে ফোন করছেন, আমি যেন তার গুলশান কিংবা মাদানী এভিনিউর জমিটি ক্রয় করি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় নসরুল হামিদের জমি কেনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া এত পরিমাণ অর্থও এ মুহূর্তে আমার হাতে নেই। তাই অপারগতা প্রকাশ করেছি। 

তিনি আরও বলেন, নসরুল হামিদ আমাকে বলেছেন- তার বেশির ভাগ সম্পত্তিই বিক্রি করে দেবেন। এ জন্য তাকে যেন ক্রেতা খুঁজে দেই এমন অনুরোধ করেছেন। এরই মধ্যে তিনি ছোট আকারের কিছু প্লট ও বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে শুনেছি। 

হুন্ডি ব্যবসা সংশ্লিষ্ট এক ব্যবসায়ী জানান, নসরুল হামিদসহ আওয়ামী লীগের পলাতক এমপি-মন্ত্রীদের বড় অংশ তাদের সম্পত্তি বিক্রির টাকা ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় সরিয়ে নিচ্ছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ী নসরুল হামিদসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের অর্থ পাচারে সহায়তা করছেন।

তবে, আগে থেকেই ওই সব দেশে অনেকের বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। তাদের স্ত্রী ও সন্তানরাও সেখানে বসবাস করে আসছেন। একইভাবে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দুই সন্তানও বিদেশে থাকেন। 

এর আগে, ২০১৪ সাল-পরবর্তী এক দশকের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নসরুল হামিদ বিপু। মন্ত্রণালয়টির মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা। ওই সময়ে এ মন্ত্রণালয়কে ঘিরে সরকারের সবচেয়ে বেশি অর্থের অপচয় ও লুটপাট হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে নিজের ব্যবসা ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে নসরুল হামিদ বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। 

বিগত ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের তথ্য জানিয়ে নসরুল হামিদ জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়।

বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১২২ টাকা দরে) এ বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল ২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার (৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ হয়েছে। 

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে গত দেড় দশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গণহারে কয়েক ডজন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে। এ আইনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই দর-কষাকষির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। আর শেখ হাসিনা নিজেই এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় নসরুল হামিদ একাই পুরো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সর্বেসর্বা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি বিভিন্ন প্রকল্প ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিতেন।

বিদ্যুৎ খাতের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, গত এক দশকে দেশে যতগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন পেয়েছে, তার প্রতিটির বিনিময়ে নসরুল হামিদকে শতাংশের হিসাবে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ খাত থেকে তার প্রাপ্ত ঘুষের পরিমাণই হবে হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া, বিদ্যুৎ খাতের পাশাপাশি এলপিজি ও এলএনজি আমদানিতেও বিভিন্নভাবে ভাগ বসিয়েছিলেন নসরুল হামিদ।

এদিকে, ২০২১ সালে দেশে এলপিজি আমদানিতে বৃহৎ একটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল সরকার। বিপুল বিনিয়োগের এ প্রকল্পটি বাগিয়ে নিতে সিঙ্গাপুরে নিজের মামার নামে নসরুল হামিদ একটি শেল কোম্পানি খুলেছিলেন। ওই কোম্পানিসহ আরও দুই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ভিটল ও জাপানের মারুবেনি করপোরেশনকে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তির জন্য নির্বাচিত করতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তিনি। গুরুতর এ দুর্নীতির বিষয়টি ওই সময় প্রকাশ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নসরুল হামিদকে পিছিয়ে আসেন।

নসরুল হামিদের পৈত্রিক ব্যবসা ছিল জমি ক্রয়-বিক্রয় তথা রিয়েল এস্টেটের। তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপ। এ গ্রুপের অধীনে হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, হামিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, হামিদ ইকোনমিক জোন, হামিদ ফ্যাশন লিমিটেড অ্যান্ড হামিদ সোয়েটার লিমিটেড ও হামিদ এগ্রো লিমিটেডের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। হামিদ গ্রুপের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ব্র্যান্ড হলো ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে রয়েছেন তার ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। বিপুর মতো তিনিও বর্তমানে পলাতক।

সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও নসরুল হামিদ কিংবা তার ভাই ইন্তেখাবুল হামিদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরগুলো বন্ধ রয়েছে। এমনকি বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে হামিদ গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিজেদের নাম উদ্ধৃত করে কেউ বক্তব্য রাজি হননি।  

তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, নসরুল হামিদ বিপু ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সচল ছিল। কিন্তু এর পর থেকেই পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হয়েছে। বেশ কিছু কর্মীকে এরই মধ্যে ছাঁটাই কিংবা ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কোম্পানির রিয়েল এস্টেট ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। বেশ কিছু জমি এরই মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি। 

এ ব্যাপারে নসরুল হামিদের নির্বাচনী এলাকা কেরানীগঞ্জ এলাকার স্থানীয়রা জানান, গত দেড় দশক ধরে নসরুল হামিদের কথাই ছিল কেরানীগঞ্জের আইন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গত আট মাসে অনেকেই তাদের বেদখল হওয়া জমি দখলে নিয়েছে। যদিও নসরুল হামিদ এসব জমি প্লট বানিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা নসরুল হামিদের সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন। ওই নেতার অনুসারীরা নতুন করে মানুষের জমি দখল নিতে শুরু করেছেন। 

প্রসঙ্গত, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৯৮টি ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ১৮১ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে এরই মধ্যে নসরুল হামিদ বিপুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিপু ছাড়াও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার স্ত্রী সীমা হামিদ ও ছেলে জারিফ হামিদের নামেও পৃথক মামলা করেছে সংস্থাটি। গত ডিসেম্বরে দায়ের করা এসব মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।

এর আগে, নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২২ আগস্ট দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই দিন তার প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। এ সময় ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’ নামে ভবনের ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি ভল্টে থাকা নগদ অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রা এবং অস্ত্র-গুলিসহ অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে।

আরটিভি/কেএইচ

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |