মিশরের আবু খালিফা হাসপাতালে আট মাস ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আটকে থাকা দুই অগ্নিদগ্ধ প্রবাসী বাংলাদেশি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কৌশলগত হস্তক্ষেপেই তারা মুক্তি পেয়েছেন।
হাসপাতালের প্রায় ১৫ লাখ টাকার বিল মওকুফ করিয়ে গত ২২ এপ্রিল দূতাবাস তাদের হাসপাতাল থেকে মুক্ত করে আনা হয়। এরা হলেন, কিশোরগঞ্জের মো. হান্নান মিয়া (৪২) ও ফরিদপুরের লুৎফর রহমান (২৬)।
জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এয়াহিয়া তানভির এই তিন বাংলাদেশিকে মিশরে ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যকের কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে অকে-টু- বোর্ড অন-এরাইভ্যাল ভিসায় নিয়ে আসেন মিশরে। কায়রো বিমান বন্দরে নামার পর এদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ইসমাইলিয়া শহরে। সেখানের কান্তা এলাকায় একটি ছোট পোশাক কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসাবে মাত্র ১০০ ডলার বেতনে চাকরি দেয় এয়াহিয়া। তিনজন মিলে এক রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে দিন কাটছিল ওই তিন প্রবাসীর।
অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহে একদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরে রাতের খাবার রান্না করতে গিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তিন জন। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় প্রথমে তাদেরকে ইসমায়েলিয়া আবু-খালিফা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ফাইজুল ইসলামের অবস্থা অবনতি হওয়ায় মিশরের পুলিশ তাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে নিয়ে যায় জাগজিগ হাসপাতালে। সেখানে তিনদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ফাইজুল। পরিবারের ইচ্ছায় কায়রোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ফাইজুলের লাশ কফিন বন্দি করে পাঠায় দেশে।
এদিকে কিশোরগঞ্জের মো. হান্নান মিয়া ও ফরিদপুরের লুৎফর রহমান একমাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে চাইলে চিকিৎসার ব্যায় বিল পরিশোধ না করায় হাসপাতালেই আটকিয়ে রাখে তাদের।
খবর পেয়ে কায়রোস্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মিস সামিনা নাজের নির্দেশে আবু খালিফা হাসপাতালে ছুটে যান দুতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি গিয়ে জানতে পারেন দুজনের হাসপাতালের বিল এসেছে ১১ হাজার ইউএস ডলার।
হান্নান ও লুৎফর জানান, তাদের কাছে কোনো টাকা পয়সা এমনকি পাসপোর্ট ও জামা কাপড় কিছুই নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দুই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও বিশাল অংকের এই বিল দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে বলে জানান দুতাবাসের কাউন্সিলর।
এ নিয়ে দূতাবাস, হাসপাতাল, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি করেও সমস্যার সমাধান না করতে পেরে আবু খালিফা হাসপাতালকে বিল মওকুফ করার জন্য অনুরোধ পত্র পাঠায় দুতাবাস। এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে জানানো হয় যে, এই দুই বাংলাদেশির থাকা খাওয়াসহ বিল এসেছে প্রায় ১৪ হাজার ডলার ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
হাসপাতাল ও দুতাবাসের মধ্যে দীর্ঘ ছয়মাস দর কষাকষির পর অবশেষে ২ হাজার ডলার (২ লাখ ৫০ হাজার টাকা) পরিশোধ শেষে ২২ এপ্রিল দুতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর মো. ইসমাইল হোসেন তাদেরকে মুক্ত করে আনেন।
কাজের প্রলোভন আর মিথ্যা আশ্বাসে ওকে-টু - বোর্ড অন-এরাইভ্যাল ভিসায় মিশরে লোক আনার কারিগর এয়াহিয়া তানভির ঘটনার পরপরই গা ঢাকা দেয়। তাকে বহুবার ফোন করে তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।
দীর্ঘ ৮ মাস হাসপাতালে বন্দি থেকে বেরিয়ে হান্নান ও লুৎফর জানান, ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় মিশরে এসেছিলাম।
আসার আগে আমাদেরকে বলা হয়েছিল মিশরে থাকা খাওয়াসহ ভালো বেতনের চাকরি দেবে। আসার পর দেখলাম সবই ছিল মিথ্যা আশ্বাস। দুর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর স্যার আমাদের দেখতে আসেন ও কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেন। আমাদের চিকিৎসা বিল নিয়ে হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলতে বেশ কয়েকবার উনি এখানে এসেছেন। যেহেতু আমাদেরকে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে আনা হয়নি সেহেতু দুতাবাস কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ও নিতে পারেননি। তারা আরো বলেন, তানভিরের মতো দালালদের মিষ্টি কথার প্রলোভনে অবৈধভাবে প্রতারিত হয়ে আর কেউ যেন এদেশে এসে এমন অবস্থায় না পড়েন।
আজ দীর্ঘ ৮ মাস পর মিশরের মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারছি। দুতাবাসের রাষ্ট্রদূত ম্যাডাম সামিনা নাজ ও কাউন্সিলর ইসমাইল স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। উনাদের সহযোগিতা না পেলে হাসপাতালের এই বিশাল অংকের চিকিৎসা বিল না দেওয়ার কারণে আমাদের জেলে যেতে হতো। আশা করি আমাদের পুড়ে যাওয়া পাসপোর্টি রি- ইস্যু করতে দুতাবাস সাহায্য করবেন।
আরটিভি/এআর