ফেসবুকের ১৪৮ অ্যাকাউন্ট-পেজ বন্ধ নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি
সংঘবদ্ধভাবে অসত্য প্রচারের কারণে বাংলাদেশের ৫০টি ফেসবুক আইডি ও ৯৮টি পেজ বন্ধ করেছে ফেসবুক৷ এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও দলটির গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন (সিআরআই)-এর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে মেটা৷ প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এসব অপকর্মের নেপথ্যে যারা রয়েছে, তারা ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে, যার অনেকগুলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই চিহ্নিত হয়েছে এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
বৃহস্পতিবার ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে৷ মেটা যেসব অ্যাকাউন্ট বন্ধের কথা বলেছে তার মধ্যে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদের টুইটার অ্যাকাউন্টও রয়েছে৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তন্ময় আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ফেসবুক যেভাবে লিখেছে, তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি৷ এভাবে তো তারা লিখতে পারে না৷ এই আইডি বা পেজগুলো কারা চালায়, সেটা তো তারা নিশ্চিত নয়৷ কিন্তু তারা ঢালাওভাবে যে অভিযোগ করেছে, সেটা সত্যি নয়৷ আবার ওই তালিকায় আমার টুইটার অ্যাকাউন্টের কথা বলা হয়েছে, অথচ আমার টুইটার অ্যাকাউন্টটি চালু আছে৷ শিগগিরই আমি আমার ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে সবাইকে বিষয়টি জানাবো৷
এই ১৪৮টি পেজ ও আইডি বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কিছু জানে কিনা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই৷ আমরা তাদের কাছে কিছু আইডি বা পেজের ব্যাপারে সুপারিশ করি, সেগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়৷ এগুলো তারা কিভাবে করেছে, আমরা কিছুই জানি না৷
মেটার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চক্রটি বাংলাদেশভিত্তিক এবং এদেশের মানুষই ছিল তাদের প্রধান টার্গেট৷ এই পেজগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি একেবারে কল্পিত কোনো সংস্থার পরিচয় দিয়েছে৷ আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের নাম ব্যবহার করেছে৷ কিছু পেজ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নাম ব্যবহার করেছে এবং বিএনপিবিরোধী কনটেন্ট পোস্ট করেছে৷ এসব পেজের বিচরণ ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও ছিল৷ পাশাপাশি নিজেদের ওয়েবসাইটও ছিল৷
এই ধরনের অপপ্রচারের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-র সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-মহাপরিদর্শক শ্যামল কুমার নাথ ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই ১৪৮টি পেজ বা আইডির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না৷
তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)-র সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার তারেক আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, বিভিন্ন ঘটনায় আমরা ফেসবুকের কাছে তালিকা পাঠাই৷ সেখানে এই নামগুলো আছে কিনা, সেটা তো না দেখে বলা যাবে না৷ তবে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আইডি বা পেজগুলোর বিরুদ্ধেই আমরা রিপোর্ট করি৷ যে পেজ বা আইডিগুলো বন্ধ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল, সেটা তো আমরা জানি না৷
মেটার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চক্র প্রধানত বাংলা ভাষায় এবং ইংরেজিতে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, বিএনপির সমালোচনা, বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, নির্বাচন পূর্ব সহিংসতায় বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নিয়ে সংবাদ ও চলতি ঘটনা পোস্ট করতো৷ পাশাপাশি বর্তমান সরকার, ক্ষমতাসীন দল এবং বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এর ভূমিকা এসব সমর্থন করে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতো৷
মেটা বলছে, তারা অনুসন্ধানে এসব কর্মকাণ্ড স্প্যাম ও অসত্য কর্মকাণ্ড বলে দেখতে পেয়েছে৷ যদিও এর নেপথ্যের ব্যক্তিরা তাদের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেছে, তারপরেও মেটার অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগ এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন সিআরআইর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে৷
সরিয়ে দেওয়া আইডি ও পেজগুলোতে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩৪ লাখ ফলোয়ার ছিল৷ এসব পেজ থেকে ৬০ ডলার বিজ্ঞাপনের জন্য খরচের কথাও জানিয়েছে মেটা, যা টাকায় পরিশোধ করা হয়েছে৷ এই আইডি বা পেজগুলোর বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো অভিযোগ করেছিল কিনা জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমরা সরাসরি মেটার কাছে কোনো অভিযোগ করিনি৷ কিন্তু আমরা আগাগোড়াই বলে আসছি, আমাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার করছে৷ এতদিন এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে কেউ গুরুত্ব দেয়নি৷ কিন্তু এখন মেটা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় প্রমাণিত হলো, আমরা যে অভিযোগ এতদিন করে আসছিলাম, সেটা সত্যি৷
বিএনপির নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে, আমরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করবো, কিন্তু এখানে কোনো ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক খবর প্রচার করবো না৷ অথচ আমাদের বিরুদ্ধে এগুলো হচ্ছে৷
তবে মেটার এই ধরনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এভাবে একটা দলের বিরুদ্ধে লিখতে পারে না৷ ওই আইডি বা পেজগুলো কারা চালাতো? কোনো বিএনপি সমর্থকও ওগুলোর মালিক হতে পারেন৷ আবার সারা বিশ্বে আমাদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, সেটা তো তারা দেখলো না৷ বিদেশে বসে পিনাকি কী করছে, অন্যরা কী করছে? আমি তো মনে করি, এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত৷ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তো প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে৷ এখন সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যা ইচ্ছে তাই করা হবে, সেটা তো মেনে নেওয়া যায় না৷ বাংলাদেশে এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি থাকা জরুরি৷ আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবো৷ এ ব্যাপারে অবশ্যই আমরা কিছু একটা করবো৷
মন্তব্য করুন