ঢাকাশনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

গুইসাপই কি সান্ডা?

আরটিভি নিউজ

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫ , ১০:৪০ পিএম


loading/img
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে ‘সান্ডা’ নামের একটি মরু প্রাণী। ভাইরাল ভিডিও, হাস্যরসাত্মক পোস্ট, মেম—সবকিছুর কেন্দ্রে এখন এই নিরীহ টিকটিকি সদৃশ জীবটি। এই প্রাণীকে ‘মাস্টিগুর’, ‘সান্ডা টিকটিকি’, কিংবা ‘কাঁটা লেজযুক্ত টিকটিকি’ নামেও ডাকা হয়।

বিজ্ঞাপন

নামের সঙ্গে সাপ যুক্ত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো সাপ নয়। এটি মূলত সরীসৃপ; বড়সড়ো টিকটিকির মতো দেখতে। তবে এর জিব সাপের মতো দ্বিখণ্ডিত। নামের সঙ্গে সাপ যুক্ত হওয়ার কারণেই হয়তো প্রাণীটি সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে। ফলে এর অস্তিত্বকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ ১৪ আগস্ট World Lizard Day পালিত হচ্ছে। মূলত উপকারী এ প্রাণীটির গুরুত্ব তুলে ধরতেই দিবসটি পালিত হয়। যদিও বাংলাদেশে প্রাণীটি নিয়ে তেমন কোনো দিবস পালনের তথ্য পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞাপন

সান্ডা আসলে কী?

সান্ডা হলো একটি টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Uromastyx। এটি দেখতে অনেকটা গুইসাপের মতো হলেও এর শরীর তুলনামূলক ছোট এবং এর মোটা। এর খাঁজযুক্ত লেজ আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রাণীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়—‘মাস্টিগুর’, ‘সান্ডা টিকটিকি’, কিংবা ‘কাঁটা লেজযুক্ত টিকটিকি’।

মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে এই প্রাণীটির আবাস। এটি তৃণভোজী, অর্থাৎ গাছপালা, ফুল ও বীজ খেয়ে জীবনধারণ করে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পোকামাকড়ও খেতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন

গুইসাপ নিয়ে কিছু গুজব

গুইসাপ সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত অনেক তথ্য রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই ভুল ও অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশ বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা এবং তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক জোহরা মিলা মনে করেন, এসব গুজবই প্রাণীটির অস্তিত্বকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘গ্রামগঞ্জের মানুষ এখনও মনে করে প্রাণীটি বিষধর ও ভয়ংকর। অনেক এলাকার মানুষ মনে করে, এরা থু-থুর মাধ্যমে মানুষকে লক্ষ্য করে বিষ ছিটিয়ে দেয়। কোনো কোনো এলাকার মানুষ মনে করে, গুইসাপের লেজ বিষাক্ত। প্রাণীটি লেজ দিয়ে মানুষকে আঘাত করে, আর ওই বিষের কারণে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এসব তথ্যের সবই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’

‘গ্রামাঞ্চলের মানুষ কবিরাজি ওষুধ তৈরি করতে অনেক সময় গুইসাপ হত্যা করে। গুইসাপের লেজ দিয়ে তাবিজ, চর্বি থেকে হাঁপানির তেল তৈরিসহ নানারকম ওষুধ তৈরির কথাও শোনা যায়। কিন্তু এসব ওষুধের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই; বরং এর মাধ্যমে কিছু অসাধু ব্যক্তি দেশের সরল মানুষকে ঠকাচ্ছে,’ যোগ করেন জোহরা মিলা।

তিনি জানান, প্রকৃতপক্ষে গুইসাপ কোনো সাপই নয়। এর কোনো বিষও নেই, মানুষকে দংশনও করে না।

নিরীহ প্রাণীটির সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য

জোহরা মিলা জানান, বাংলাদেশে তিন ধরনের গুইসাপের দেখা মেলে। এগুলো হচ্ছে: গুইসাপ (Bengal monitor), সোনালি গুই (Yellow monitor) ও রামগদি বা কালো গুই (Water monitor বা Ring lizard)। এর মধ্যে গুইসাপ দেশের সর্বত্র কমবেশি দেখা যায়। সোনা গুই-এর বাস দেশের পাহাড়ি এলাকায়। অন্যদিকে রামগদি বা কালো গুই মিঠা পানি ও লোনা পানির মোহনা তথা উপকূলীয় অঞ্চল, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল বাস করে। রামগদি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গুইসাপ। এটি লম্বায় ৭ থেকে ৯ ফুট এবং ওজন ২৫ কেজিরও বেশি হতে পারে। এদের আলাদা করা কিছুটা কঠিন, তাই সব কটি প্রজাতিই মানুষের কাছে গুইসাপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই প্রাণীটি এলাকাভেদে তারবেল, গুইল, ঘোড়েল ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

তিনি বলেন, গুইসাপ শান্ত স্বভাবের প্রাণী। এরা সাধারণত মাটির গর্ত, গাছের কোটর, পুরোনো দেয়ালের ফাটল, পরিত্যক্ত ইটভাটায় বাস করে। প্রাণীটি দিবাচর। তাই দিনে শিকার করে আর রাতে বিশ্রাম নেয়। সাধারণত বিষধর সাপ ও সাপের ডিম, মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, শামুক, পচা-গলা প্রাণিদেহ ইত্যাদি খায়। তবে ধানক্ষেতের ইঁদুর, ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে বলে একে ‘কৃষকের বন্ধু’ও বলা হয়। এরা দ্রুত গাছে উঠতে পারে। সাঁতারেও অত্যন্ত দক্ষ। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জলাভূমির পাশে এদের আবাসস্থল দেখা যায়।

গুইসাপ অত্যন্ত উপকারী প্রাণী হলেও মানুষ অকারণেই একে শত্রু বানিয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, গুইসাপ কমে যাওয়া মানুষের জন্য ভালোকিছু নয়। প্রাণীটি কমে গেলে পরিবেশে ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় বেড়ে যাবে, ইঁদুরের উৎপাত বাড়বে, বাড়বে বিষাক্ত সাপ। তা ছাড়া পঁচা-গলা প্রাণিদেহ খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে। তাই গুইসাপের ক্রমহ্রাসমান অবস্থার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি রোগ-জীবাণুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জীববৈচিত্র্য।

গণহারে গুইসাপ হত্যা
গুইসাপের চামড়া বেশ উন্নতমানের ও দামি। বিশ্ববাজারে এর বেশ চাহিদা রয়েছে। তাই এর চামড়া দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ, ম্যানি ব্যাগ, বেল্ট তৈরি করা হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে দেশ থেকে ৫১ লাখ ৪৩ হাজার টাকার গুইসাপের চামড়া রফতানি হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায়, ওই সময় দেশব্যাপী গণহারে গুইসাপ হত্যা করা হয়েছিল।

অবশ্য পরে পরিবেশগত গুরুত্ব ও ক্ষতির মাত্রা অনুধাবন করে ১৯৯০ সালে গুইসাপ হত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এই উদ্যোগের পর প্রাণীটির জীবনের প্রতি হুমকি অনেকটাই কমে এসেছে। তবে ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।

পরে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন) ২০০০ সালে প্রাণীটিকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব বুঝতে না পারা এবং বিভিন্ন গুজবের কারণে উপকারী এই প্রাণীটি এখনও প্রতিনিয়ত বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। যার বেশির ভাগই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তা ছাড়া এখনও চোরা শিকারিরা গুইসাপ শিকার করে গোপনে এর চামড়া বিদেশে পাচার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া কোনো কোনো জনগোষ্ঠী খাবারের জন্যও গুইসাপ হত্যা করে। অনেক সময় খাবারের সন্ধানে কৃষকের বাড়িতে হানা দেয় গুইসাপ। তখন প্রাণীটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তা ছাড়া প্রজননক্ষেত্র এবং আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া গুইসাপ কমে যাওয়ার আরও একটি কারণ।

গুইসাপ হত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী প্রতিটি বন্যপ্রাণীই সংরক্ষিত বলে জানান বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী। তিনি জানান, ব্যাপক নিধন ও বাসস্থান ধ্বংসের কারণে গুইসাপের অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) গুইসাপের তিনটি প্রজাতির মধ্যে রামগদি বা কালো গুইকে ‘সংকটাপন্ন’ এবং ‘গুইসাপ’ ও ‘সোনালি গুই’কে ‘প্রায় সংকটাপন্ন’ বলে তালিকাভুক্ত করেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী গুইসাপ সংরক্ষিত। তাই এটি হত্যা, শিকার বা এর কোনো ক্ষতি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আরও পড়ুন

সংরক্ষণে নেই কর্মসূচি

গুইসাপ এত উপকারী প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও প্রাণীটি রক্ষায় আলাদাভাবে বন অধিদপ্তরের কোনো প্রকল্প বা কার্যক্রম নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক (চলতি) ইমরান আহমেদ বলেন, আমাদের দেশের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, রয়েছে জনবলেরও স্বল্পতা। সে কারণে ছোট ছোট প্রাণীর জন্য আলাদাভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। তবে যেসব প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, কেবল সেসব প্রাণীকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলাদাভাবে প্রকল্প পরিচালনা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এটা ঠিক যে, বন অধিদফতর সব ধরনের বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য সারা বছরই নানারকম সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে। মানুষও এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী অনেক স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তি ও সংস্থা আছে, যাদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিটি প্রাণী রক্ষায় কাজ করছে বন অধিদপ্তর। 

স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে যৌথ এই প্রচেষ্ট ছোট-বড় সব প্রাণীর জন্যই ইতোমধ্যে দারুণ কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আরটিভি/এসকে

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |