নদীর এপার আর ওপার করতে করতে তার কেটে গেছে দীর্ঘ ৩০ বছর। শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার জয়ন্তী নদীর খেয়াঘাটের নারী মাঝি তিনি। দীর্ঘদিন ধরে নৌকা টানেন। উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে দুইশ গজ দূরে ধীপুর গ্রামের মৃত কালু ব্যাপারীর বড় মেয়ে মিলন নেছা (৫২)।
রোববার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, জয়ন্তী নদীতে মিলন তার নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করছেন। ছোট বড় সবাই তাকে খালা বলে ডাকছেন। একজন নদী পার হলে ৫ টাকা করে দিচ্ছেন। দুপুরের লোক কম থাকায় ভাসমান নৌকায় বসে রান্না করছেন তিনি। বড় কষ্টের জীবন তার। এরপরেও মুখে জেনো হাসি লেগেই আছে।
আরটিভি নিউজকে মিলন নেছা জানান, জয়ন্তী নদীর খেয়াঘাটে তার বাবা কালু ব্যাপারী মাঝির কাজ শুরু করেন। তার বয়স যখন ২২ বছর তখন বাবা মারা যান। তারা তিন বোন আর তিন ভাই। সংসার ও ভাই-বোনদের মানুষ করতে ওই বয়সেই অভাবের সংসারের হাল ধরতে মাঝির কাজ শুরু করেন।
তিনি আরও জানান, যখন মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন তখন একজন মানুষ পার করলে এক টাকা করে পেতেন। কয়েক বছর পর ২ টাকা এবং এখন ৫ টাকা করে নদী পারাপার করেন। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন তিনি। তাছাড়া দুই পারের কিছু মানুষ বছরে যা ফসল পায় তার একটি অংশ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
বাবা কালু ব্যাপারী মাঝির ঘরে জন্ম নেন মিলন নেছাসহ ছয় ছেলে-মেয়ে। বাপ দাদার কোনও জমিজমা না থাকায় তিনি স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন নদীর পাড়ের ছাউনি নৌকায়। নৌকার মাঝেই সংসার আর সেই সংসারে জন্ম নেয় সন্তানরা। মিলন নেছাসহ ছয় সন্তানেরই বিয়ে হয়েছে।
বাবার পথ অনুসরণ করে বেছে নেয়া নৌকার মাঝির কাজে কোনোভাবে জীবন আর জীবিকা চালিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটছে মিলন নেছার। তবুও যেন হাল ছাড়ার পাত্রী নন তিনি। তাই কষ্ট হলেও নৌকার মাঝির কাজ করছেন। করোনাকালে কিছু সরকারি খাদ্যসামগ্রী পেয়েছেন। তাছাড়া কোনও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য পাননি।
মাঝি মিলন নেছা আরটিভি নিউজকে বলেন, আমার স্বামী রহম আলী সরদার ১৫ বছর আগে আমাকে ও দুই ছেলেকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। আমাদের আর কোনও খোঁজ নেননি তিনি। বড় ছেলে আব্দুল খালেক (২৬)। বিয়ে করে আলাদা থাকে। আর আমি নদীর পাড় ছাউনি নৌকায় ছোট ছেলে আব্দুল মালেককে (২২) নিয়ে এক সঙ্গে থাকি। নৌকাতেই রান্না-খাওয়া, নৌকাতেই আমার বসবাস। ২২ বছর নৌকা পারাপার করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি। এখন আর পারি না। জীবনের শেষ সঞ্চয় দিয়ে ৬ শতক জমি কিনেছি। কিন্তু ঘর তুলতে পারিনি। বড় ইচ্ছা একটি ঘর হলে সন্তান নিয়ে থাকতাম।
মিলন আরও বলেন, নৌকা চালানো আমার পেশা। এতদিন অতি যত্নে ধরে রেখেছি। নৌকা চালাতে চালাতে কখন যে কেটে গেল জীবনের ৩০ বছর তা বুঝতেই পারিনি। আর দুই পারের মানুষগুলো আপন হয়ে গেছে। তাই এ পেশা ও মানুষকে ভালোবেসে মাঝির পেশা আঁকড়ে ধরে আছি।
মিলনের ছোট ছেলে আব্দুল মালেক বলেন, আমার মায়ের বয়স হয়েছে। তবুও নদীতে নৌকা চালায়। যে অর্থ পান, তা দিয়ে চলছে আমাদের সংসার। মাঝে মধ্যে আমি ইটের ভাটায় শ্রমিকের কাজ করি। বড় কষ্টে চলছে আমাদের জীবন। একটি ছাউনি নৌকায় আমাদের বসবাস। সরকারিভাবে যদি একটি ঘর পেতাম মাকে নিয়ে সুখেই কাটতো দিনগুলো।
নৌকা পারাপার হওয়া গোসাইরহাট পৌরসভার শম্ভু ঘোষ (৬০) ও রুহুল আমিন সরদার (৩৫) বলেন, মিলন খালা সহজ-সরল মানুষ। তিনি এ ঘাটে বিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীসহ দুই পারের মানুষ পারাপার করেন। আমরাও পারাপার হই। একবার পার হলে ৫ টাকা দেই। তাকে ছাড়া নদীর এ ঘাট শূন্য লাগে। আমরা এলাকার মানুষ মিলন খালাকে অনেক ভালোবাসি। তিনি সারাদিন নৌকা পারাপার করেন। রাতে নৌকায় থাকেন। তার ঘর নেই। সরকার বা কোনও বৃত্তবান ব্যক্তি যদি তাকে একটি ঘর দিত তাহলে ভালো হতো।
গোসাইরহাট উপজেলা সমাজসেবা অফিসার নাজমুল হাসান বলেন, মিলন নেছার নৌকায় আমি নদী পারও হয়েছি। তিনি একজন নারী মাঝি। তিনি যেহেতু ভাতার আওতাভুক্ত হননি, তাই তাকে বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্ত ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। সেক্ষেত্রে একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রত্যয়নপত্র লাগবে।
গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও গোসাইরহাট পৌরসভার প্রশাসক মো. আলমগীর হুসাইন বলেন, মিলন নেছা একজন নৌকার মাঝি জানতাম না। বিষয়টি জেনে পৌরসভার পক্ষ থেকে তার খোঁজ নিতে বলা হয়েছে। তার যেহেতু স্বামী নেই, তাই বিধবা ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। সকল সামাজিক সুবিধা ও সামাজিক বেষ্টনীতে রেখে আর কোন ক্যাটাগরিতে পরে সেটা বিবেচনা করে আমরা সহযোগিতা করবো। যদি বাড়ি না থাকে তাহলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘খ’ তালিকাভুক্ত যারা ভূমিহীন আছে তাদের তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করবো।
জিএম/পি