ঢাকাবুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

জেদ, লড়াই, ভালোবাসা: বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিঃশব্দ স্থপতি মুশফিকুর রহিম

মোঃ আরিফ

বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫ , ০৭:১৭ পিএম


loading/img
ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেট মাঠের ছোট্ট খুদে শরীরটি, গায়ের ঝাঁঝালো আত্মবিশ্বাস, আর হৃদয়ের বিশালতা—এই তিনটি শব্দেই মুশফিকুর রহিমকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নিঃশব্দ সৈনিক, যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন, কিন্তু কখনও নিজের কৃতিত্ব নিয়ে অহংকার করেননি।

বিজ্ঞাপন

তাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, নেই অহংকার কিংবা বাহুল্য আবেগ। কিন্তু তার চোখের গভীরতা বলে দেয়, কতটা ভালোবাসেন এই দেশকে, কতটা ভালোবাসেন এই খেলাকে। বিশ্বকাপ হোক কিংবা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ, ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত মুশফিকের ব্যাট কথা বলেছে, তার গ্লাভস প্রতিটি ক্যাচকে করেছে নির্ভরযোগ্য, হয়ত তিনি সবচেয়ে লম্বা নন, হয়ত সবচেয়ে শক্তিশালী শট খেলেন না, কিন্তু যখন বাংলাদেশকে প্রয়োজন, তখন তিনিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। আর তার হাসি—সেটা যেন প্রতিটি টাইগারভক্তের হৃদয়ে এনে দিয়েছে স্বস্তি। 

সময়টা ২০০৫। বয়স তখন মাত্র ১৬, গায়ে লাল-সবুজের জার্সি। সামনে লর্ডস, ক্রিকেটের মক্কা। হাতে ব্যাট, চোখে স্বপ্ন, আর হৃদয়ে অদম্য জেদ—বাংলাদেশকে কিছু দেওয়ার জেদ। সেদিন হয়ত শরীরে ওজন ছিল না, অভিজ্ঞতাও কম, কিন্তু মনোবল? সেটার কোনো অভাব ছিল না। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম কনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে যখন তিনি ঐতিহাসিক লর্ডসে অভিষিক্ত হলেন, তখন হয়ত অনেকেই ভেবেছিল—এই ছেলেটা কতদূর যেতে পারবে?

বিজ্ঞাপন

কিন্তু মুশফিক জানতেন, তার লড়াইটা আজকের জন্য নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য। সেদিনের সেই কিশোরই একদিন হয়ে উঠবেন দলটির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নিঃশব্দ নায়ক।

২০০৭ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ওডিআইতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে নিজের জাত চেনান। তখনো হয়ত কেউ জানতো না, এই ছেলেটিই একদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠবে।

২০১২ সালে যখন বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে পৌঁছাল, তখন দলের নেতৃত্বে ছিলেন এই মানুষটি। সেই আসরে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কার মতো পরাশক্তিদের বধ করে যখন বাংলাদেশ ফাইনালে উঠল, তখন ক্রিকেট বিশ্ব নতুন করে বাংলাদেশকে চিনল। কেননা, সে দিন বাংলাদেশ শুধুই একটা দল ছিল না, ছিল এক স্বপ্নের প্রতিচিত্র। বাংলাদেশ জিততে পারে, বাংলাদেশ লড়াই করতে পারে—এটাই ছিল সেই ফাইনালের সবচেয়ে বড় অর্জন। এমনকি ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ২ রানে পরাজয়, তাও সেই স্বপ্ন ম্লান করতে পারেনি। কারণ, সেদিন থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন যুগ শুরু হলো—একটি দল, যারা শুধু অংশগ্রহণ করতে আসে না, তারা জিততে চায়। এবং সেই মানসিকতার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম।

বিজ্ঞাপন

২০১৩ সালের মার্চের এক উষ্ণ দুপুর। গলের সবুজ গালিচার মতো উইকেটের ওপরে দাঁড়িয়ে এক ক্ষুদ্রাকার যোদ্ধা। সাদা পোশাকে আবৃত, কপালে তীব্র ঘাম, চোখে-মুখে এক অদম্য জেদ। প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, ম্যাচটা টেস্ট ক্রিকেটের, যেখানে বাংলাদেশের তেমন কোনো ইতিহাস নেই। কিন্তু সে দিন বাংলাদেশ শুধু ম্যাচ খেলেনি, বাংলাদেশ ইতিহাস লিখেছিল। 

‘ডাবল সেঞ্চুরি? ওটা তো শুধু বড় দলের প্লেয়াররাই করে!’ এই কথা কেউ না কেউ বলেছিল, হয়ত উচ্চস্বরে, হয়ত নিঃশব্দে। বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান এর আগে কখনোই ২০০ ছুঁতে পারেননি।

মুশফিক আসার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু গল টেস্টে তিনি একাই সেই বাস্তবতা বদলে দিলেন।  ১৯১, ১৯৫, ১৯৯...একমাত্র তিনিই জানেন, সেই মুহূর্তগুলোতে বুকের ভেতর কেমন অনুভূতি হচ্ছিল।  সেই গল টেস্টে যখন তার ব্যাট ২০০ রানের ম্যাজিক ফিগার ছুঁলো, তখন শুধু একটা সংখ্যা পূর্ণ হয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট নতুন উচ্চতায় উঠে গেল। বিশ্বকে জানান দিল—‘আমরাও পারি, আমরাও সক্ষম।’ আর সেই ইতিহাসের নাম ছিল মুশফিকুর রহিম। 

বাংলাদেশ ক্রিকেট নতুন যুগে প্রবেশ করলো। তার দেখানো পথেই হাঁটা শুরু করলো বাংলাদেশ ক্রিকেট! 
কোনো পথপ্রদর্শকের কাজ শুধু নিজের জন্য লড়াই করা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথ তৈরি করে দেওয়া। যে রাস্তা তিনি খুলে দিলেন, সেই পথ ধরেই এলেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুমিনুল হক। তাদের ডাবল সেঞ্চুরির গল্পগুলো হয়ত আমাদের রোমাঞ্চিত করে, কিন্তু সেই গল্পের প্রথম অধ্যায়টি লিখেছিলেন একজনই—মুশফিকুর রহিম।

২০১৮ নিদাহাস ট্রফির সেই ম্যাচটি কে ভুলতে পারে? শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২১৪ রানের লক্ষ্যে যখন দল ব্যাট করতে নামে, তখন মনে হচ্ছিল, এটা অসম্ভব এক লড়াই। কিন্তু এক প্রান্তে যখন মুশফিক দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন বিশ্বাসটা বেঁচে ছিল। ৩৫ বলে ৭২ রানের এক বিস্ফোরক ইনিংস খেললেন তিনি—যেন নিঃশব্দ এক চিৎকার! চার-ছক্কার বন্যায় গ্যালারি উত্তাল, পুরো বাংলাদেশ শ্বাস ধরে রেখেছে টিভি স্ক্রিনের সামনে। আর শেষ মুহূর্তে জয় নিশ্চিত করেই সেই বিখ্যাত ‘নাগিন নাচ’  উদ্‌যাপন! কত আনন্দ, কত আবেগ! সেই রাতটি কেবল ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশের লড়াই করার মানসিকতার প্রতীক হয়ে রইল।

বৃষ্টি ভেজা বিকেলে, কিংবা কাঠফাটা রোদ, যখনই দল বিপদে, তখন ছোটখাটো গড়নের এই মানুষটিই পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন। একা লড়ে গেছেন, যেন একটা বলও হার মানতে না পারে তার জেদি ব্যাটের সামনে। ক্লান্ত শরীর, তীব্র মানসিক চাপ—সব কিছুকে পেছনে ফেলে তিনি দাঁড়িয়ে থেকেছেন বাংলাদেশের সম্মানের জন্য।

আজ যখন বিদায়ের গান বাজে, তিনি যখন ওডিআই ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন, তখন শুধুই এক ফরম্যাট থেকে বিদায় নয়, বরং একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। ১৯ বছর ধরে দলের জন্য অবিরাম খেটেছেন, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। কখনো ক্যাপ্টেন, কখনো নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান, কখনো দলের শান্ত অথচ শক্ত নেতা—সব ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন নিখুঁত।

 

মুশফিকুর রহিমকে উৎসর্গ করে তাই বলতে হয়—

তুমি চিরকাল থাকবে, মুশফিক
তুমি আজ হয়ত ওডিআই থেকে সরে দাঁড়িয়েছ,
কিন্তু তোমার গল্প, তোমার অবদান কখনোই মুছে যাবে না।
কারণ ইতিহাস মনে রাখবে—
বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির নায়ক হিসেবে,
প্রথম এশিয়া কাপ ফাইনালের নেতা হিসেবে,
বাংলার প্রথম বিশ্বমানের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস যতদিন লেখা হবে,
মুশফিকুর রহিমের নাম ততদিন থাকবে সেই পাতার মাঝখানে, গর্বের অক্ষরে।
 ধন্যবাদ, মুশফিক। তুমি শুধু একজন ক্রিকেটার নও, তুমি আমাদের ইতিহাসের একটি অংশ। 

লেখক: ডেপুটি ম্যানেজার, ডিএসএম, আরটিভি

 

আরটিভি/ ডিসিএনই

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |