দর্শক সারি থেকে

বিদেশে কিউই বধ : আশার বেলুনে বাড়তি জ্বালানি

জাফর উল্লাহ সোহেল

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০১৭ , ০৩:৫৭ পিএম


বিদেশে কিউই বধ : আশার বেলুনে বাড়তি জ্বালানি

ক’দিন ধরে ১১ বছর আগে করা ব্রায়ান লারার একটা মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ঝগড়া-ঝাটি চলছে। কেউ ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তিকে ধুয়ে দিচ্ছেন আর কেউ এর প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদকারীরা বলছেন, লারা ঠিকই বলেছিলেন। তা ক্রিকেটের বরপুত্র কী বলেছিলেন? ২০০৬ সালে তিনি বলেছিলেন ‘বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা উচিত না’। এর অবশ্য একটা শর্ত ছিল। তিনি বলেছিলেন যেহেতু জিম্বাবুয়ে খেলতে পারছে না, সুতরাং বাংলাদেশও খেলা উচিত না। যে অবস্থাতেই হোক আর যেই বলুক, প্রাথমিকভাবে কোনো টাইগারভক্তই বিষয়টি মানতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন

২০০৬ সালেও এটা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এখন এই ২০১৭ তেও একটা অনলাইন পত্রিকা নিউজ করার পর সমালোচনার তীর ছুটে যাচ্ছে লারার দিকে। আবার অনেকে লারাকে প্রটেক্ট করে বলছেন- ১১ বছর আগের পরিস্থিতিতে লারা ঠিকই বলেছিলেন। এখন যেমন আমরা বাংলাদেশও তো চাইব না আফগানিস্তান কিংবা নেপালের মতো কোনো দল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলুক! কেননা এটা তো বড় দলগুলোর মঞ্চ, আর কে না জানে বাংলাদেশ এখন মাঠে আর মাঠের বাইরে সমান তালে বড় দল! এখন লারারা আর সাহসই করবেন না অমন বেখেয়ালী মন্তব্য করার।

র‌্যাঙ্কিংয়ে একটু আগে ৬ নম্বর জায়গাটা দখল করেছে বাংলাদেশ। এই প্রথম। ১১ বছর আগে কোনো বাংলাদেশি কি এই অবস্থান কল্পনা করেছিল? আমি করিনি। কিন্তু বাস্তবতা হল বাংলাদেশ এতদিনে অনেক কিছুই করেছে এবং আমার ধারণা আরো অনেক কিছু করবে, যা খুব কম বাংলাদেশিই এখন বিশ্বাস করে। এমনকি এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই সেই অনেক কিছুর কিছু একটা দেখে ফেলতে পারে বিশ্ব। এই বিশ্বাস আমার জন্মেছে।

বিজ্ঞাপন

আয়ারল্যান্ডের মাটিতে যে ম্যাচটা মাত্রই টাইগাররা জিতে নিল কিউই পাখিদের ভুপাতিত করে এর তাৎপর্য টাইগারদের জন্য এতোই বহুমুখী যে, ত্রিদেশীয় সিরিজটি পয়েন্ট ব্যবধানে না জিততে পারার আফসোসের ছিটেফোটাও দেখা গেল না। ফাইনালবিহীন এই অদ্ভূতুড়ে সিরিজ থেকে মাশরাফি বাহিনীর পাবার ছিল কিছু জ্বালানি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উত্তপ্ত লড়াইয়ে নামার আগে নিজেদের গায়ে একটু তাপ লাগিয়ে রাখার সেই কাঙ্ক্ষিত জ্বালানি টাইগাররা পেয়ে গেছে। এবং তা আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে এই কিউই বধের ম্যাচ থেকেই। কারণ, যতই আপনি ১০টা আয়ারল্যান্ডকে হারান না কেন ওইটুকু আত্মবিশ্বাস আসবে না যতটা নিউজিল্যান্ডের মতো দলকে এক-আধবার হারিয়ে আসবে। তাও বিদেশের মাটিতে।

বুধবারের ম্যাচটি সত্যিকার অর্থেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে আশার বেলুনে কিছু বাড়তি জ্বালানি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এমনিতে যে বেলুনে গ্যাসের অভাব ছিল তা নয়। সাম্প্রতিক ওয়ানডে পারফরম্যান্সও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না। এই ক’দিন আগেই তো শ্রীলংকার মাটিতে সিরিজ ড্র করে আসল। তবে, কথা হচ্ছিল দেশের এবং উপমহাদেশের বাইরে বড় দলগুলোর বিপক্ষে কতটা সফলতা আসে তা নিয়ে। এই সিরিজে প্রথম সাক্ষাতে কিউইদের কাছে হার সেই বিশ্বাসটাই ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিল সবাইকে- নাহ্, বিদেশের মাটিতে সাফল্য এত সহজে আসবে না। সহজে আসবে না, তবে কঠিন হলেও যে আসতে পারে তার উদাহরণ হয়ে গেল এই জয়টা।

ম্যাচটা এক অর্থে খুব সহজও ছিল না। ২৭১ রানের টার্গেট, তাও ভিন্ন কন্ডিশনে। পিচও একেবারে ব্যাটিংস্বর্গ নয়। কেবল বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের অন্য বাঘা দলেরাও এরকম টার্গেটে ব্যাট করতে গিয়ে হিমশিম খায়। এবং আমি জোর গলায় বলতে পারি, এই ম্যাচে যদি বাংলাদেশের জায়গায় ভারত কিংবা পাকিস্তান থাকতো তারা আরো বেশি ধুঁকতো। হারের আশঙ্কায় পড়েছে বাংলাদেশ বেশ ক’বার। বিশেষ করে সাকিব আল হাসান আউট হবার পরে তো মনে হচ্ছিল, মিছিল শুরু হয়ে গেছে- এ আর থামার নয়! কিন্তু পুরোনো দিন যে পেছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ তা আরেকবার প্রমাণ করতেই মুশফিকুর রহিম খেললেন অসাধারণ এক ইনিংস। সাহসী, প্রত্যয়ী, ক্লাসিক! এমন ইনিংস, যা অন্যদের ভেতরে রোমাঞ্চ সঞ্চরণ করবে, তাদেরকেও সাহসী করবে পরে এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বড় দান মারতে এমন সাহসী ইনিংস পথ দেখাবে দিশারির মতো। মুশির ভায়রা ভাই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ইনিংসটির মূল্যও কিন্তু কম নয়। এর মূল্য হল এই যে, মাহমুদ উল্লাহ তার ২০১৫ বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পুন:মুদ্রণের আত্মবিশ্বাস পাবে। আর দল পাবে এই আত্ববিশ্বাস যে, আমাদের তো মাহমুদুল্লাহ আছে!

বিজ্ঞাপন

বোলারদের তূণেও কিছু প্রাপ্তিযোগ হবে এই ম্যাচ থেকে। কিউই ইনিংস যেভাবে তরতর করে পাহাড়ে উঠছিল তাতে একসময় তো রান ৩শ’ পার হয়ে যাবে মনে হচ্ছিল। বোলারদের মুন্সিয়ানার কল্যাণেই কিন্তু এর রাস টেনে ধরা গেছে। এবং শেষ দিকে টপাটপ উইকেট নিয়ে এমনকি রস টেলরের মতো ব্যাটসম্যানকেও খোলসবন্দি করে রাখার ক্রেডিটও নিতে পারে বোলাররা। বিশেষ করে, টেলএন্ডে রুবেল হোসেনের বোলিং কতটা কার্যকরি তা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে।

বিগ ম্যাচে কীভাবে শুরু করতে হয়, কীভাবে বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে মাঝ দরিয়ায় কান্ডারী হতে হয় আর কীভাবে চূড়ান্ত লক্ষ্যে যাওয়া যায়- এমন অনেক অভিজ্ঞতা এই এক ম্যাচেই হয়েছে টাইগারদের। জুন মাসের ইংলিশ কন্ডিশনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচগুলোতে এমন অনেক মুহূর্তের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। সন্দেহ নেই সেখানে এই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট পরিমাণে কাজে দেবে। ক্রিকেটারদের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আশার আকাশে আত্মবিশ্বাসী যে বেলুন উড়ে বেড়াচ্ছে তাতে বাড়তি জ্বালানি যোগ করেছে কিউইদের বিপক্ষে বহু তাৎপর্য্যময় এই জয়। এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সাফল্যের আকা্ঙ্ক্ষার গ্রাফটাও নিশ্চয়ই আরেকটু উঁচুতে জায়গা পাবে। কে জানে, উপলক্ষপ্রিয় বাংলাদেশ দল চাইলে ঈদ উপহার হিসেবে ভক্তদের কিছু দিলেও দিতে পারে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে!

লেখক ও সাংবাদিক

কে/জেএইচ

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission