ভারতবর্ষে নারীদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। ২০২৩-এ ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, এদেশে প্রায় ২৩ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে।
দুটি অসমসাহসী নারীর গল্প বলে ভারতবাসীর মন জয় করেছিল কিরণ রাও পরিচালিত ২০২৪-এর হিন্দি ছবি লাপাতা লেডিজ। কী ছিল সেই ছবিতে?
দুজন অল্প বয়সী অবগুণ্ঠিত কনে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে অদল বদল হয়ে যান। তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিনা তা পরিষ্কার করে জানা না গেলেও একজনের লেখাপড়ার ইচ্ছেকে গলা টিপে হত্যা করে তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হয়। অপরজনের মতামত বলে বস্তুটি তার মা শিশুকালেই সমূলে উচ্ছেদ করে সেই জায়গায় সামাজিক নিয়মানুবর্তিতার প্রকাণ্ড বটবৃক্ষটি চাপিয়ে দিয়েছেন। গোটা সিনেমা জুড়ে এই দুই নারী রীতিমতো হাতে তরবারি নিয়ে স্বাধিকারের লড়াই লড়েন। একজন জেনে-বুঝে, অপরজন বাধ্য হয়ে।
হাসি আর প্রেমের আড়ালে ভারতের গ্রামে অল্পবয়সী নারীদের বাস্তব তুলে ধরে এই সিনেমাটি। এ তো গেল সিনেমা। বাস্তবের কাছাকাছি হলেও আদতে কাহিনী। ভারতের বাস্তব আর খানিকটা রূঢ়। সম্প্রতি বিহারের ১৬ বছরের একটি মেয়ে তার বাল্যবিবাহকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। দশম শ্রেণির পরীক্ষা শেষেই তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। শিক্ষিকা অথবা আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখা সেই মেয়েটিকে প্রথমে বলা হয় বিয়ের দুদিনের মধ্যেই বাবা-মায়ের বাড়ি ফিরতে পারবে সে। চালিয়ে যাবে লেখাপড়া। কিন্তু তা হয় না। সুপ্রিম কোর্টের পিটিশনে বলা হয়, বাড়ি ফিরতে চাইলে তার কপালে জোটে মার। ক্রমাগত চলতে থাকে বৈবাহিক ধর্ষণ। আইনজীবী বা শিক্ষিকা নয় শ্বশুরবাড়ির প্রয়োজন তার সন্তান- পিটিশনে এমন অভিযোগ করা হয়।
ভারতবর্ষে নারীদের বিয়ের বয়স ১৮। পুরুষদের ২১। প্রহিবিশান অফ চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট ২০০৬ অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে বেআইনি। তবে আইন দিয়ে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অন্ধকার কাটানো যায় না। ২০২৩-এ ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, এদেশে প্রায় ২৩ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর প্রতি তিন জন বালিকা-বধূর একজনের ঠিকানা ভারতে। সারা ভারতের মোট বাল্যবিবাহের প্রায় ৫০ শতাংশ হয় উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ত্রিপুরায় ৪০ শতাংশ কন্যার বাল্যবিবাহ হয়।
ভারতের বিভিন্ন অংশে স্থান, কাল এবং পাত্র নির্বিশেষে বাল্যবিবাহ প্রথা চালু আছে। কলকাতায় মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিসরে যদিও বাস্তবটা অন্য। আমার এক বন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন বিয়ে হওয়ায় তার বাল্যবিবাহ হচ্ছে এমন কথা রটিয়ে দিয়েছিলেন আমাদেরই ফাজিল বন্ধুদের একাংশ। তবে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলেও বাল্যবিবাহ প্রচলিত সত্য। গ্রামের তুলনায় কম হলেও, ২০১১-র আদমশুমারির তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গের শহরে প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটেছে। ভারতের অনেক শহরেই বাল্য বিবাহ লাগামছাড়া।
বৈষম্যের লজ্জা পুরুষ সন্তান সাবালক হয়ে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে এটাই দস্তুর। ফলে সে স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজে পৌঁছায়। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকতে পারে এমন আশায় বাবা-মায়ের যত্নের প্রাথমিক দাবিদার হয়ে ওঠে পুত্রসন্তান। তবে নারীদের তুলনায় অনেকটা কম হলেও এদেশে পুরুষদের বাল্য বিবাহও বাস্তব। ২০১১-র আদমশুমারি অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে প্রায় তিনি দশমিক তিন শতাংশ পুরুষ বিবাহিত। অন্যদিকে, নারীমাত্রই স্বামীগৃহে গমনের প্রাগৈতিহাসিক সমাজ চেতনার কারণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কন্যা সন্তানদের বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর হিড়িক লেগে থাকে। অল্প বয়সে বিয়ে দিলে কণের বোঝা খানিকাংশে কমে। তাছাড়া মেয়ের স্বাধীন সত্ত্বা তৈরি হওয়ার আগেই তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে পারলে সম্ভাব্য নানান লোকলজ্জার হাত থেকে সংসার বাঁচে। এই কারণে যেন তেন প্রকারে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাই লাভজনক বলে মনে করেন অধিকাংশ মানুষ।
কন্যা সন্তানের সার্বিক সুরক্ষাকে তার আপনজনেরাই কন্যাদায় বলে মনে করেন। কন্যা তথা পারিবারিক সম্মান তার চারিত্রিক শুভ্রতার সমার্থক। অসৎ পুত্রের তুলনায় অসতী কন্যা অনেক বেশি অসম্মানের এবং পরিহার্য। বিয়ে দিলে ল্যাঠা চুকে যায়। সম্মান এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব ঘাড় থেকে নামে। পশ্চিমবঙ্গের কন্যাশ্রী প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের বাল্য বিবাহের পরিসংখ্যান লজ্জাজনক।
তবে সামাজিক চেতনার অভাবের পাশাপাশি এর পিছনে আছে দারিদ্র্যের বাস্তবতাও। সেই অর্থকষ্টকে লাঘব করার জন্য ২০১৩-তে একটি প্রকল্প চালু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই কন্যাশ্রী প্রকল্পে ১৩ থেকে ১৮ বছরের অবিবাহিত কন্যারা পড়াশুনা চালানোর জন্য প্রতি বছর এক হাজার টাকার বৃত্তি এবং ১৮ পেরিয়ে পড়াশুনা চালানোর জন্য অবিবাহিত নারীদের এককালীন ২৫ হাজার টাকার বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়। দুটি ক্ষেত্রেই টাকা আসে স্কুলে। সেখান থেকে টাকা পান ছাত্রীরা। এই প্রকল্পে লাভবান হন বহু কন্যাসন্তান। এই প্রকল্পকে স্বীকৃতি দেয় ইউনাইটেড নেশন্স ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং ইউনিসেফ।
তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কন্যাশ্রীকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বাল্য বিবাহ প্রথা। নদীয়ার মফস্বলে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নাম প্রকাশ করার অনুমতি না দিয়েই জানান, কন্যাশ্রী প্রকল্পের অন্তর্গত বহু নারীরা আগেই বিয়ে করে নেন। সেই বিয়েকে গোপন রেখে প্রকল্পের টাকা গোনেন -- কখনো সরাসরি স্কুলের মদতে, কখনো আড়ালে।
বাল্য বিবাহতে মদত পায় দুর্নীতিও। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলায় এটা দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব। সুদূরপ্রসারী প্রভাব ২০২০ এর মহামারির সময় অনেক স্কুল বন্ধ থেকেছে। লাফিয়ে বেড়েছে বাল্য বিবাহের সংখ্যা। অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে দেওয়ার অর্থ অসময়ে শৈশব এবং কৈশোর কেড়ে নেওয়া। একজন পরিণত দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়ার সম্ভাবনাকে শুরুতেই নির্মূল করে দেওয়া। এর সামাজিক প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীদের প্রতি বৈষম্য বৃদ্ধি, নারীর উপর অত্যাচারে ঘটনাকে সরাসরি ইন্ধন দেয় বাল্য বিবাহ।
এছাড়া একটি শিশুর লেখাপড়ার অধিকার, সুস্বাস্থ্যের অধিকার এমনকি ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষারও পরিপন্থি প্রচলিত এই কুপ্রথা। তবে আরো বিপজ্জনক প্রভাব পরে অর্থনীতিতেও। বাল্য বিবাহ প্রজন্মগত দারিদ্রচক্রকে নিশ্চিত করে। তার সরাসরি প্রভাব পরে দেশের অর্থনীতিতে। একটা শিশুর অকালে বিয়ে হয়ে গেলে কেবলমাত্র সেই লেখাপড়া এবং সামগ্রিক জ্ঞান বৃদ্ধির ধারা থেকে বঞ্চিত হয় তাই না, দেশও একজন সম্ভাব্য দক্ষ কর্মীকে হারায়। তার গুরুতর প্রভাব পরে আর্থ সামাজিক পরিকাঠামোয়।
লাপাতা লেডিজে গ্রামের সাব ইন্সপেক্টর এক কন্যাকে পড়াশুনায় ফেরত পাঠান। বাস্তবে এই সাব ইন্সপেক্টররা ব্যতিক্রমী চরিত্র। শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমানোর ক্ষেত্রে এমন চরিত্রদের মূলধারায় জায়গা করে নিতে লড়াই করতে হয়। সমাজের বিরুদ্ধে, আপনজনদের বিরুদ্ধে। বাল্য বিবাহের এই অন্ধকার নিশ্চিত ভাবেই একদিনে কাটবে না। যুগ যুগ ধরে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে এই কুপ্রথা। তবে সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের সমাজও এগোচ্ছে। সংখ্যায় বাড়ছে সাব ইন্সপেক্টর শ্যামের মতো চরিত্ররা। বিহারের শিক্ষিকা বা আইনজীবী হতে চাওয়া কন্যারা সব বিপত্তি কাটিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন। একদিনে না হলেও একদিন নিশ্চয়ই বাল্য বিবাহমুক্ত হবে ভারত।
আরটিভি/এএইচ/এআর