বিদ্যুৎসেবার মান আন্তর্জাতিক না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক মানের বেতন কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)’ পরিচালিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মাসিক বেতন ও ভাতা প্রায় ১৫ লাখ টাকা, যেখানে অন্যান্য সরকারি বা যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্পে এই পদের বেতন ৫ লাখ টাকার বেশি নয়।
বেতন কাঠামোর বৈষম্য
২০১৬ সালে চালু হওয়া পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১৯ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়। সে সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মূল বেতন ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ লাখ টাকা করা হয়। পরে বাসা ভাড়া ও অন্যান্য ভাতা যোগ করে মোট মাসিক বেতন দাঁড়ায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা।
একইভাবে দ্বিতীয় সারির কর্মকর্তাদের মূল বেতন ১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়। ফলে ভাতাসহ মাসিক বেতন দাঁড়ায় প্রায় ৯ লাখ টাকা। তবে, মাঝারি ও নিম্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম এবং অনেক কর্মীর বেতন একদমই বাড়ানো হয়নি।
এই বেতন কাঠামোর পরিবর্তনটি ২০১৯ সালে বোর্ড মিটিংয়ে অনুমোদিত হয় এবং ২০২০ সালে এটি কার্যকর হয়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তবে, প্রশ্ন উঠেছে—যদি প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মানের হয়, তাহলে শুধুমাত্র শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেন এত উচ্চ বেতন এবং ভাতা দেওয়া হয়?
অন্যদিকে, একই আকারের এবং যৌথ মালিকানাধীন আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র—রামপাল প্রকল্প কিংবা আরপিসিএল-নরিনকো পাওয়ার—সেখানে সবাই সরকারি কাঠামোর বেতনেই আছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মূল উদ্দেশ্য ছিল সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বর্তমানে প্রতি ইউনিটে প্রায় ১২ টাকা, যা সাধারণ জনগণের জন্য সাশ্রয়ী নয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বেতন এবং ভাতা জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, কারণ তারা দেখছে তাদের জন্য কোনো সুবিধা আসছে না, তবে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন ও ভাতা অনেক বেশি।
শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা?
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সূত্র অনুযায়ী, এই পরিবর্তনের মূল হোতা ছিলেন পায়রার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম। তিনি বোর্ডের মাধ্যমে নিজের এবং তার ঘনিষ্ঠদের জন্য এই সুবিধা নেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং তৎকালীন বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউস এতে আপত্তি জানাননি বলেও জানা গেছে।
অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পর খোরশেদুল আলমকে পদচ্যুত করা হয়েছে এবং তার জায়গায় চীনা কোম্পানি সিএমসিয়ের একজন কর্মকর্তা, ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি চীনে অবস্থান করলেও অফিসিয়ালি তিনিই এমডি হিসেবে দায়িত্বে আছেন এবং বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন।
এ ছাড়া পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বোর্ড মিটিংয়ে বিদেশে যাওয়ার খরচ এবং মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য ভাতা দেওয়া হয়, যা একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ক্ষেত্রেও ৬০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয়, যা সরকারের ব্যয় কমানো উদ্যোগের পরিপন্থী।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম এই বেতন কাঠামোকে বৈষম্যমূলক এবং অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, দেশের বিদ্যুৎসেবার মান আন্তর্জাতিক নয়, তাহলে কিভাবে শুধু শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন আন্তর্জাতিক মানে উপযোগী করা হবে?
তিনি আরও বলেন, বেতন কাঠামো সমান হওয়া উচিত এবং যে সব বৈষম্যমূলক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা দ্রুত বাতিল করতে হবে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেতন কাঠামো এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বেতন ও ভাতা দেশের বিদ্যুৎ খাতে একটি বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যদিও এই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ, তবে শীর্ষ কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতন ও ভাতার বিতর্ক জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, যা অবিলম্বে দূর করা উচিত বলে মনে করছেন তারা।
আরটিভি/জেএম/আইএম