শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটায় অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ানসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। রোববার দুদক হবিগঞ্জ সমন্বিত কার্যালয়ে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের ফেসবুক পেইজে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারি পরিচালক মো. সহিদুর রহমান বাদী হয়ে একটি এবং উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান বাদী হয়ে আরও একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাগুলোর অপর আসামীরা হলেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আফসানা ইসলাম কাকলী এবং ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী এসএম নজরুল ইসলাম নুতন। উভয় মামলায়ই শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ানকে প্রধান আসামী করা হয়েছে।
দুদকের ফেসবুক পেইজে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, রোববার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান বাদী হয়ে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ান এবং নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আফসানা ইসলাম কাকলীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে একে অপরের সহায়তায় অন্যায়ভাবে আর্থিক লাভের জন্য প্রতারণা, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে উচ্চ মূল্য দেখিয়ে বইপত্র ক্রয় করেছেন।তারা সরকারের ১ কোটি ২৯ লাখ ৩৩ হাজার ১২১ টাকা ক্ষতিসাধন-পূর্বক আত্মসাৎ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
একই দিন দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান বাদী হয়ে আরও একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ান এবং পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী এসএম নজরুল ইসলাম নুতনকে আসামী করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, অসৎ উদ্দেশ্যে একে অপরের সহায়তায় অন্যায়ভাবে আর্থিক লাভের জন্য প্রতারণা, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে উচ্চ মূল্য দেখিয়ে যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছেন। তারা সরকারের ২ কোটি ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭শ’ টাকা ক্ষতিসাধন-পূর্বক আত্মসাৎ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
প্রকাশ, হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ৯৭ হাজার ৭শ’ ৪৮ টাকা। মালামাল ক্রয় বাবত ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১শ’ ৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয়, এমনটাই বলেছে দরপত্র প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। বাকি টাকার পুরোটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ, কিং জেনারেশন) মূল্য নেয়া হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। অথচ ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ)-এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জনপ্রতি চেয়ার-টেবিল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যয় পড়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের এর কোনো স্টিকার লাগানো নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, ৫টি স্টিলের আলমিরা ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ লাখ ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ও ৬৪৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬শ’ ৬৪ টাকা। এছাড়াও বিলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিক মডেলের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা দেখানোসহ দেশের বাজারে ‘পেডিয়াটিক সার্জারি’ (২ ভলিয়মের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা হলেও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা।
এদিকে, মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩শ’ ২৫ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩শ’ টাকা। পুনম ইন্টারন্যাশনাল এসি’র দাম ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টির মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩শ’ ৯০ টাকা, একই কোম্পানি ও একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইং (ওজন মাপার যন্ত্র) মেশিনের দাম নেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাস্তবে যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা করে। এছাড়া মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছবি সম্বলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮শ’ টাকা দরে। এ রকম ৪৫০টি চার্ট ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। দেশে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায় ‘স্টারবোর্ড‘ নামে হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চির ইন্টারেক্টিভ।
এম
মন্তব্য করুন