ঢাকাশুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পাহাড়েও সেদিন শোকের ছায়া নেমেছিল

ইয়াছিন রানা সোহেল

সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০২২ , ১২:৪৯ পিএম


loading/img
ছবি : সংগৃহীত

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বাঙালি জাতির জীবনে শোকাবহ ও কলঙ্কময় একটি দিন। এদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরস্থ ‘বঙ্গবন্ধু ভবনে’ ঘটেছিল ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী কখনও কল্পনা করেননি, এমন একটি জঘন্যতম ঘটনা এ দেশে ঘটবে।

বিজ্ঞাপন

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে পরিচিতি লাভ করে বীরের জাতি হিসেবে। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ট নেতৃত্বে সগৌরবে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামে পরাজিত শক্তির এ দেশীয় দোসররা সেই অগ্রযাত্রাকে পদদলিত করে বাঙালির অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে পাঁয়তারা শুরু করে। আর সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের এই দিনে সপরিবারে হত্যা করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সবাইকে। 

এদিন ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মুহূর্তেই ঝরে পড়ে বেশ কয়েকটি তাজা প্রাণ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূ ও শেখ মনিসহ পরিবারের ১৮ সদস্য। ঘাতকের বুলেটের আঘাত থেকে রেহাই পাইনি শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। ইতিহাসের নিকৃষ্ট ও নির্মমতম সেই হত্যাকাণ্ডের খবরে পুরো জাতিই সেদিন শোক ক্ষোভে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে কোটি বাঙালিকে মুক্ত করার পরেও স্বাধীন দেশেই যাকে বরণ করতে হয়েছে নির্মম মৃত্যুর। বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে নিহত হওয়ার খবরে পুরো দেশসহ বিশ্ব যখন বিস্ময়ে হতবাক তখন দুর্গম পাহাড়েও সেই শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা। অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল এবং কর্মী সংখ্যা কম থাকলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছিলেন সবসময় সোচ্চার। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার সংবাদে হতচকিত হয়ে পড়েন তারা। 

বিজ্ঞাপন

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর ঊশেসিং এমপি, তিনি তৎকালিন বান্দরবান মহকুমা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। বীর বাহাদুর ঊশেসিং সেদিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনাটি সকালে আমরা রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারি। এই খবর শোনার পর পুরো পার্বত্যঞ্চলে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। চারদিক নীরব, চুপচাপ। কোনো প্রকার প্রতিবাদ কিংবা বিক্ষোভ হয়নি। সবাই শুধু হা-হুতাশ করছিল। 

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ও রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার তৎকালীন ছাত্রনেতা। সেদিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের ছিল না এবং আমার জাতীয় রাজনীতিতে কোনো পদ-পদবিও ছিল না। তবে সে সময় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড আমরা মেনে নিতে পারিনি। বিবেকের তাড়নায় আমার মতো অনেকেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারিনি। সে সময় কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের নেতৃত্বে আমিসহ সৈয়দ তালুকদার, নাসিম ওসমান, শাহ আজিজ, মান্নান, তরুণ, ফারুক আহমদ, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আবদুল হালিম, সাইদুর রহমানসহ অনেকেই আমরা প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলি।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার। আওয়ামী লীগের যেকোনো কর্মকাণ্ডে এবং কর্মসূচিতে সম্মুখভাগে থেকেই কাজ আঞ্জাম দিতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর নিজের প্রতিক্রিয়ার স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, সেদিন আমি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীস্থ আমার ফুফুর বাসায় ছিলাম। সকালে ফুফু এসে বললেন, বাইরে কীসের যেন হইচই হচ্ছে। একটু বের হয়ে দেখ তো। বাইরে এসে রেডিওতে শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। আর রাস্তায় দেখলাম লোকজন একজন শুধু আরেকজনের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শোকে-ক্ষোভে আমি নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। রাঙ্গামাটি ফিরে আসি। রাঙ্গামাটিতেও দেখি সবকিছুই নীরব। লোকজন আতঙ্কের মধ্যে আছে। ১৬ আগস্ট জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক আকতার হোসেন, সমাজসেবা সম্পাদক রেজাউল, দপ্তর সম্পাদক মমতাজুল হকসহ কয়েকজন রিজার্ভ বাজারে গোপনে বৈঠক করি। আমাদের করণীয় কী হতে পারে, সে ব্যাপারে সংক্ষেপ আলোচনা করি। যেহেতু ঢাকা-চট্টগ্রামের কোনো নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা তখন সম্ভব হচ্ছিল না। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দুর রহমানও রাঙ্গামাটি ছিলেন না। সাংসদ সুদীপ্তা দেওয়ানও তেমন কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো সিনিয়র কোনো নেতা নেই। এমন এক ভীতিকর পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন সম্ভব নয়। ক্ষোভের আগুন ভেতরেই জ্বলছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেদিন প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ আমরা করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ নুরুল আবছার ক্ষোভ ও দুঃখে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। 
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন দপ্তর সম্পাদক মমতাজুল হক। সেদিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে এই নেতা বলেন, ১৯৭৫ সালে আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও বসতাম। সেদিন সকালে দোকানে এসে রেডিওতে শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। খবরটা শুনেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। দোকান থেকে বেরিয়ে শহীদ আবদুল আলী একাডেমির সামনে দলীয় কার্যালয়ের দিকে এগিয়ে আসি। কিন্তু অফিস বন্ধ। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচলও কম। চারদিকে ভীতিকর এক পরিস্থিতি। ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের খুঁজতে যাবো তারও পরিবেশ নেই। ফিরে যাই বাসায়। পরের দিন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার, ছাত্রলীগ নেতা আকতার, শাহ আলম, আবুল বশরসহ কয়েকজন রিজার্ভ বাজারে গোপনে বৈঠক করি। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন পরিস্থিতি একটাই ভয়াবহ ছিল যে, প্রকাশ্যে কিছু করা অনেক কঠিন। তাছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও বের হচ্ছেন না। কেউ কেউ চলে যান আত্মগোপনে। কিছুই করতে না পারার ক্ষোভে দুঃখে ফুসতে থাকি।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ও তৎকালীন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. শাহ আলম, বীর উত্তম-এর ছোট ভাই কাপ্তাই থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী। 

বিজ্ঞাপন

সেদিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, কাপ্তাই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। মাত্র এক মাস আগেই (১৪ থেকে ১৬ জুন ১৯৭৫) বঙ্গবন্ধু কাপ্তাই সফর করেছিলেন এবং এখানে দুই রাত অবস্থান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবরে কাপ্তাইবাসী শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। করণীয় কী হতে পারে, সে জন্য কাপ্তাই থানা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক বাদশা, ছাত্রলীগ নেতা রমজান আলী, বাদলসহ আমরা কয়েকজন গোপনে বৈঠক করি। তখন কাপ্তাই থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন কাজী নুরুল ইসলাম এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আমার বাবা আলী আহমদ চৌধুরী। তারাও কোনো প্রকার কথা বলছিলেন না। চারদিকে শুনসান নীরবতা আর ভীতিকর অবস্থা। মিছিল মিটিং করার মত সাহস করছিল না কেউ।   

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |