ঢাকাসোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

হিসাব লেখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই স্কুলে ভর্তি হন ৬৫ বছরের মান্নান

ফেরদৌস জুয়েল, গাইবান্ধা প্রতিনিধি

বুধবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ০৪:৪৪ এএম


loading/img
ছবি : আরটিভি

পড়ালেখা শিখতে ৬৫ বছর বয়সে কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন আবদুল মান্নান নামে এক পান দোকানদার। 

বিজ্ঞাপন

প্রথম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর ৩৭। পান দোকানে বাকি লেনদেনের হিসাব লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 
কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে কথা বলে তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে নেন। এই বয়সে স্কুলে ভর্তি হতে পেরে আবদুল মান্নান অনেক আনন্দিত।  

তিনি বলেন, অনেক আগেই আমার বাবা তছিম উদ্দিন ও মা মুসলিমা বেগম মারা যান। সংসারে সব সময় অভাব লেগেই থাকত। অনেক কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। ছয় ভাই, এক বোনের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। কখনো লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে চোখে পানি চলে আসে। 

বিজ্ঞাপন

জীবনসংগ্রামে নানা পেশা বদলে আবদুল মান্নান এখন গ্রামে সড়কের পাশে বসে খিলি পান বিক্রি করেন। কিন্তু পড়াশোনা না জানায় এখানেও নানাভাবে ঠকেন তিনি। অনেকেই তার থেকে বাকিতে পান নিয়ে পরে পুরো টাকা শোধ করেন না। অক্ষরজ্ঞান নেই বলে হিসাবও রাখতে পারেন না তিনি। সে জন্য জীবনের শেষ সময়ে এসে পড়ালেখা শেখার উদ্যোগ নিয়েছেন। 

ছোটবেলা থেকে দিনমজুরের কাজ করেছেন। এরপর প্রায় দুই যুগ রিকশা চালান। এক সময় বয়সের কারণে রিকশা চালাতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে খিলি পান বিক্রি শুরু করেন। স্থানীয় বাজারে রাস্তার পাশে তার ছোট্ট দোকান। এখানে চার বছর ধরে তিনি খিলি পান বিক্রি করছেন। সকালে বিদ্যালয়ে যান। বিকেলে ছুটির পর দোকানে বসেন।

আবদুল মান্নানের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী গ্রামে। ব্যক্তি জীবনে মালেকা ও জান্নাতী নামে দুই মেয়ে ও মমিরুল নামে এক ছেলেসহ তিন সন্তানের বাবা তিনি। মেয়েদের বিয়ে হলেও ছেলে পলাশবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষার্থী। বড় মেয়ের ছেলে মাহফুজা বিয়ে করেছেন। তার ছেলের নাম কাওসার। যে সম্পর্কে আবদুল মান্নানের পুতি। সেই পুতির সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন আবদুল মান্নান।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

শ্রেণি শিক্ষিকা সুরভী আকতার বলেন, আমার ১২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এত বেশি বয়সী কাউকে শিক্ষা দেইনি। তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন। একজন বৃদ্ধ মানুষকে শেখাতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

অপর শিক্ষক মানিক মিয়া জানান, শিক্ষার যে কোনো বয়স নেই, তা আবদুল মান্নান চাচা প্রমাণ করেছেন। আমরা শিক্ষকরা খুবই খুশি। আমরা তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে সব কিছু শেখানোর চেষ্টা করছি।  

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে কাশিয়াবাড়ী গ্রামের বিদ্যালয়টিতে যেতে হয় পলাশবাড়ী উপজেলা শহর থেকে গ্রামের পথ ধরে। 

ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নাতি-নাতনির বয়সী শিশুদের সঙ্গে বসে পাঠ গ্রহণ করছেন আবদুল মান্নান। মনোযোগ দিয়ে পড়া শুনছিলেন। কখনো আশপাশে তাকাচ্ছেন। কখনো বই নাড়াচাড়া করছেন। 

আবদুল মান্নান বলেন, প্রতিদিন সকালে বই-খাতা-কলম হাতে নিয়ে নাতি মাহফুজার রহমানের ছেলে (স্থানীয় ভাষায় পুতি) কাওসার মিয়ার (৬) হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাই। 

ওই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র আহাদ বলেন, আবদুল মান্নান আমাদের নানার বয়সী। তারপরও তিনি আমাদের সঙ্গে পড়ছেন। আমাদের তাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। প্রথম শ্রেণির অন্য ছাত্রছাত্রীরাও একই কথা বলেছেন।

কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান মণ্ডল বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনুরোধ করে আসছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে বইও দেওয়া হয়েছে। তিনি শিশু শিক্ষার্থীদের মতোই নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন। ক্লাসের শিশু ছেলেমেয়েরাও তাকে পেয়ে খুশি।

পলাশবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম মোকসেদ চৌধুরী বলেন, দেরিতে হলেও আবদুল মান্নান লেখাপড়া শেখা প্রয়োজন মনে করেছেন, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এ বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজে হিসাব রাখতে পারলে তার কাজে লাগবে। 

তিনি বলেন, আবদুল মান্নানের পড়ালেখার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বলা হয়েছে।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |