ঢাকামঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

হ-য-ব-র-ল অবস্থায় মনপুরা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র

মনপুরা প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

বুধবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৩ , ০৮:০৯ পিএম


loading/img
ছবি : আরটিভি

দীর্ঘ আড়াই যুগ ধরে মনপুরার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটিতে নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নিয়মিত আবাসিক অফিসার কর্মস্থলে থাকেন না। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে উৎপাদন কেন্দ্রে কোনো অপারেটর, টেকনেশিয়ান নেই। ১৫ বছর ধরে কোনো উচ্চমান সহকারী হিসাব রক্ষক নেই। লাইনম্যান নেই একজনও, বিদ্যুতের লাইন মেরামতের হেলপার (সাহায্যকারী) ও ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে চলছে মনপুরার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এতে ভোগান্তিতে রয়েছে দ্বীপ উপজেলা মনপুরার দেড় লাখ মানুষ। 

বিজ্ঞাপন

দক্ষ লোকের অভাবে অদক্ষ লোকগুলোর কাছে দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়ার কারণেই মনপুরার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটিতে সীমাহীন অনিয়ম, লুটপাট চলছে। দিনের ১৮ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। রাতের ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলেও বারবার লোডশেডিং হয়। জ্বালানি তেলের সঠিক ব্যবহার না থাকা, অবৈধ সংযোগ ও বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অনিয়ম, আবাসিক কর্মকর্তার উদাসীনতায় এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন উপজেলার বাসিন্দারা।

মনপুরা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কবি সীমান্ত হেলাল বলেন, আবাসিক অফিসার আব্দুস সালাম সকল দুর্নীতির কারিগর। গত মাস দুয়েক আগেও আবাসিক অফিসার আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মনপুরার মানুষ বিশ্বাস করে এই অনিয়মের সঙ্গে ওজোপাডিকোর ওপর মহল জড়িত। 

বিজ্ঞাপন

নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি রিয়াদ মোল্লা বলেন, মনপুরার মানুষের কাছে দিনবদল আর স্মার্ট বাংলাদেশ কি জানে না তারা। তাদের একমাত্র দাবি ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ না থাকায় বাচ্চারা লেখাপড়া করতে পারে না। হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না বিদ্যুতের অভাবে। 

হাজীরহাট বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের অভাবে ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চলছে না কোনো কল কারখানা। জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হচ্ছে না। ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা থাকলেও আমরা ৬ ঘণ্টা পাচ্ছি, তাও লোডশেডিং থেকে নিস্তার নেই। লুটপাট ছাড়া বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন কোনো কাজই করতে জানে না। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম করেছি কোনো কাজ হয় না আর হবে বলেও আমাদের বিশ্বাস হয় না।

তথ্যমতে, মনপুরা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) এই উপকেন্দ্রটিতে উপজেলা সদরের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ৮৫০ জন গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য রয়েছে ৫০০ কেভির দুইটি, ৬৩০ কেভির একটি ১ মেগাওয়াটের একটি ইঞ্জিন। বিভিন্ন সময় এসব ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। আগে বিচ্ছিন্ন এলাকাটিতে ২৪ ঘণ্টায় ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দেওয়া হলেও এখন রাতে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। 

বিজ্ঞাপন

মনপুরার আবাসিক প্রকৌশলী আব্দুস সালাম বলছেন, মনপুরা উপজেলা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি প্রতি বছরে ৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে মনপুরাবাসিকে সার্ভিস দিচ্ছেন। এর বাহিরে তাদের কিছু করার নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১২ জুন ২০২৩ সোমবার, ঝালকাঠি জেলার পদ্মা অয়েল কোম্পানী থেকে মনপুরার আবাসিক প্রকৌশলী আব্দুস সালাম এইচ এস ডি ১৫১০ কোডের ১২০ ব্যারেল (২৪ হাজার লিটার) জ্বালানি তেল মনপুরার ওয়েস্ট পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নামে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ৩২০ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন।

মনপুরার যে ইঞ্জিন চালিত জেনারেটর আছে তার হিসাব অনুযায়ী ক্রয়কৃত জ্বালানি দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৮০ লিটারে ১ হাজার ৬০০ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ৫ ঘণ্টায় ৪০০ লিটার জ্বালানি খরচ করে ৮ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে প্রতি মাসে ১২ হাজার লিটার জ্বালানি দিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। অবশিষ্ট ১২ হাজার লিটার জ্বালানি যার ক্রয়মূল্য ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা হিসেবে প্রতি মাসে অবশিষ্ট থাকবে। 

একজন অফিস স্টাফ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জহীর, হেলপার বিল্লাল আমাগো স্যারের ডান হাত। বিল্লালের বাপের কিছু ছিল না কিন্তু সে এখন কোটিপতি। দামি সিগারেট, দামি পোশাক, দামি গাড়ি ছাড়া বিল্লালের চলে না। বেলাল হেলপার হলেও তাকে দিয়ে গত ১৫ বছর যাবৎ প্রকৌশলী সালাম মেশিন চালিয়ে নিচ্ছেন এবং মেশিন নষ্ট করার পেছনে বেলালের হাত রয়েছে। আর জহীর ভাইকে স্যার এখানে ভাড়া করে এনেছেন। স্যারের খুব বিশ্বাসের লোক, টাকা পয়সার সকল হিসাব তার কাছে। 

আবাসিক প্রকৌশলী আব্দুস সালামের হিসেব অনুযায়ী বছরে ৬ কোটি টাকা কোম্পানির লোকসান হলে জ্বালানি থেকে বেঁচে যাওয়া বছরে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার হদিস কোথায়। ১টি মিটার থেকে ১০ থেকে ১৫টি অবৈধ সংযোগের অস্তিত্ব মেলে। অবৈধ সংযোগকারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ অফিসের এক অসাধু কর্মচারীকে কালেকশন দিতে হয়। সর্বোচ্চ ৩ মাস বকেয়া বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় সংযোগ দিয়ে আর সি/ডিসির ৬৩০ টাকা দুইজন অফিস স্টাফ ভাগ করে নেয়। প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার ইউনিটের বিদ্যুৎ বিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনজিওর আদলে দৈনিক বা সপ্তায় কাল্কেশন করেন মি. জহির মিয়া। যা বিদ্যুৎ ও জালানি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা দুর্নীতি, অনিয়মের কথা স্বীকার করে একজন আরেক জনের ওপর দোষারোপ করছেন। এবং বলছেন এগুলোর সব কিছু স্যার (আব্দুস সালাম) জানেন।

আবাসিক প্রকৌশলী আব্দুস সালাম সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রতি মাসে আমাদের কোম্পানি ৪৫ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা লোকসান দিয়ে মনপুরা বাসিকে সেবা দিচ্ছেন। আমাদের যতটুকু ক্যাপাসিটি আছে ততটুকুই করছি এর বাহিরে নয়। আপনি আসেন অফিসে দাওয়াত রইল। 

ভোলা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকোর) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইউসুফকে মনপুরা অফিসের অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন ব্যস্ত আছি। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে। তারপর তিনি ফোন কেটে দেন। 

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |