• ঢাকা বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
logo

যশোরে চলছে খেজুরের রস আহরণের প্রস্তুতি

যশোর প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৮
ছবি : আরটিভি

শীতের আমেজের সাথে সাথে শুরু হয়েছে খেজুর গুড়ের রাজধানী খ্যাত যশোরে রস আহরণের প্রস্তুতি। ইতোমধ্যেই খেজুর গাছ কাটা শুরু করেছেন গাছিরা। বিভিন্ন অঞ্চলে এখন গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খেজুরের রস আহরণের পূর্ব প্রস্তুতিতে। প্রকৃতির পালাবদলে এখন প্রভাতে শিশির ভেজা ঘাস আর সামান্য কুয়াশার আবরণ জানান দিচ্ছে শীত এসেছে।

কথায় আছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ তাই শীতের মৌসুম শুরু হতে না হতেই গাছ থেকে রস আহরণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে যশোর অঞ্চলে। গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। রস সংগ্রহের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে খেজুর গাছের আগায় তোলা দেওয়ার কাজ চলছে। ধারালো দা (গাছি দা) দিয়ে খেজুর গাছের মাথার সোনালি অংশ বের করা হয়। যাকে যশোরের ভাষায় বলে, গাছ তোলা হয়। ৮ থেকে ১৪ দিন পর নোলন স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হবে সুস্বাদু খেজুর রস আহরণের মূল কাজ। তার কিছুদিন পরই গাছে লাগানো হবে মাটির পাতিল। সংগ্রহ করা হবে মিষ্টি স্বাদের খেজুরের রস। তা দিয়ে তৈরি হবে লোভনীয় গুড় ও পাটালি।

যশোর জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আশপাশের অঞ্চলগুলোর বেশির ভাগ গ্রামে এখনও চোখে পড়ে খেজুর গাছের বিশাল সমারোহ। জমির আইলে ও পতিত জায়গায় অসংখ্য খেজুর গাছ লাগিয়েছেন এলাকার কৃষকরা। বিশেষ করে সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা মেলে এ দৃশ্য। এছাড়াও বাঘারপাড়া, অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর, ঝিকরগাছা, চৌগাছা, শার্শা ও বেনাপোলসহ বিভিন্ন এলাকার গ্রামজুড়ে রয়েছে বিপুলসংখ্যক খেজুর গাছ।

অল্পদিনের মধ্যে চির সবুজের বুকচেরা অপরূপ সৌন্দর্যে সকলের মন মাতিয়ে তুলবে মিষ্টি খেজুর রস ও গুড়ের ঘ্রাণ। কাক ডাকা ভোর থেকে চলবে রস সংগ্রহ। বিকালে চলবে গাছ পরিচর্যার কাজ। চলতি মৌসুমে যশোরের বিভিন্ন উপজেলার প্রান্তিক গাছিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ জনপদের গ্রামে গ্রামে সকালের শিশিরের সাথে অনুভূত হচ্ছে মৃদু শীত।

আর মাত্র কয়েক দিন পর রস সংগ্রহ করে রস থেকে গুড় ও পাটালি তৈরি শুরু হবে। চলবে প্রায় ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে চোখে পড়ছে। খেজুর রস ও গুড়ের জন্য চৌগাছার সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও গাছি। একদশক আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ পতিত জমিতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ।

শীত মৌসুমে রস-গুড় উৎপাদন করে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে এ উপজেলার কয়েক শত কৃষক পরিবার। এ থেকে স্থানীয় কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হয়।
রস আহরণের প্রস্তুতি সম্পর্কে কথা হয় যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের আলতাফ হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, একটা গাছের ডাল-পালা কেটে প্রস্তুত করতে কয়েকদিন সময় লাগে। গাছির অভাবে বাইরে থেকে লোক এনে প্রাথমিক কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপর রস আহরণের কাজ নিজই করবো।

একই গ্রামের আবু জাফর বলেন, ‘আমাদের গ্রামে অন্তত দশ হাজার খেজুরের গাছ রয়েছে। গাছি আমরা তিনজন। এই তিনজন মিলে এক হাজারের মত গাছ কাটতে পারবো। বাকি গাছ পড়ে থাকবে। কিছু মানুষ বাইরের জেলা থেকে লোক এনে গাছ প্রস্তুতির কাজ করছেন। গাছির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদন করে বেশ লাভবান হওয়া যেত।

সরেজমিনে দেখা যায় যশোরের চৌগাছা ও বাঘারপাড়ায় খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উঠান বৈঠক, গাছি সমাবেশ, খেজুরের গুড়ের মেলা ও ব্যাপকভাবে খেজুর গাছ রোপণ করা হয়েছে।

কথা হয় চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা ইউনিয়নের নিয়ামতপুর এলাকায় মিজানুর মিয়ার ছেলে গাছি আব্দার রহমান, মসলেম আলীর ছেলে বাবু, মৃত এরশাদ আলীর ছেলে নুর হোসেন নুরো, রমজান আলীর ছেলে নাজিম উদ্দীন ও আমজেদ হোসেনের ছেলে গাছি গেসু মিয়ার সাথে। তারা জানান, খেজুরের গুড় পেতে শীত মৌসুমের শুরুতেই গাছ প্রস্তুত শুরু করেছি। এ বছর একটি গাছ প্রস্তুত করতে মুজুরি ১২০ টাকা। একজন দিনে ১৫/১৬টি গাছ প্রস্তুত করতে পারে।

বাঘারপাড়া গাছি আফজাল হোসেন বলেন, আমাদের কাজ খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা গাছের অনেক ওপরে ওঠে ধারালো দা দিয়ে গাছ চাঁছি। খালি পায়ে গাছে উঠতে হয়, কখনো কখনো গাছে সাপও থাকে, তাই সতর্ক থাকতে হয় সবসময়। তবে শীত মৌসুমে রস সংগ্রহ করে আমরা বেশ ভালো আয় করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, আমরা দিনরাত খেটে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। এই রস থেকে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। শীত আসার আগে গাছগুলো ভালো করে প্রস্তুত করতে হয়। যাতে রস বেশি পাওয়া যায়। কষ্ট বেশি। কিন্তু যখন গুড় তৈরি হয়। তখন সেই কষ্টের ফলটা দেখতে ভালো লাগে।

চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের পেটভরা গ্রামের গাছি আব্দার রহমান বলেন, শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার মহা উৎসব। শহর থেকে সকলে গ্রামের বাড়িতে আসে রস-গুড় খেতে। তবে নতুন করে কেউ আর খেজুর গাছ তোলা-কাটার কাজ করতে চাচ্ছে না। তবে খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে। একটি খেজুর গাছ ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। এছাড়া খেজুর পাতা জ্বালানি কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনসহ বন বিভাগের নজরদারি না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

খাজুরা এলাকার গাছি আলী হায়দার এ বছর ২০০ গাছ প্রস্তুত করছেন তিনি। এসব গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে ছয় মাস সংসার চলবে। আশা করছেন এই ৫ মাসে লক্ষাধিক টাকা বাড়তি আয় হবে।

চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসাব্বির হুসাইন বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল। রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুমে আসার সাথে সাথে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে। আমরা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের গাছিদের এ পেশায় টিকে থাকার জন্য প্রশিক্ষণ, উঠান বৈঠক, সমাবেশ করেছি।

চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা বলেন, ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ এ আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যরক্ষা করতে উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ও পতিত জমিতে খেজুর গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। খেজুর গুড় ইতিমধ্যে জি আই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ পেশার সাথে জড়িত গাছিদের নিয়ে সমাবেশ করে তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। এ মৌসুমেও গুড় মেলা করা হবে।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) প্রতাপ মণ্ডল বলেন, যশোরের খেজুর রস ও গুড়ের সুনাম ধরে রাখতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। কৃষকদের উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গাছি তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চার শতাধিক গাছিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমেও ১০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পাশাপাশি নতুন করে খেজুরের বীজ বপন করা হচ্ছে। এর ফলে রস আহরণ ও গুড় তৈরির পরিমাণ বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, যশোরে ১৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৮০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস আহরণযোগ্য গাছের পরিমাণ চার লাখ দুই হাজার ৪৩৫টি। এর মধ্যে তিন লাখ ৪ হাজার ৫টি গাছ থেকে ৫ হাজার ১২৫ জন গাছি রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কাজ করবেন।

আরটিভি/এএএ

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বাসে মিলল হেলপারের রক্তাক্ত মরদেহ, পাশে ছিল রক্তমাখা চাকু
যশোরে বাঁশবাগানে মিলল শিশুর মরদেহ, আটক ১
যশোরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত
ভারতে পালানোর সময় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার