গাইবান্ধায় স্কুল ও সওজের জায়গা দখল করে পুলিশের চাইনিজ রেস্তোরাঁ!
গাইবান্ধা শহরের পুরাতন জেলখানা মোড়ে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে কতিপয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য চাইনিজ রেস্তোরাঁ খুলে ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। রেস্তোরার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুলিশ ক্যাফে’। এতে সড়কের জায়গা সংকুচিত হওয়ায় শহরের গোল চত্বরে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় একজন ট্রাফিক পুলিশ কন্সটেবল নিহত ও রেস্তোরার দোতলার ছাদে বিদ্যুৎ স্পর্শে ট্রাফিক সার্জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রেস্তোরাটি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। এরপর এটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। সম্প্রতি এটি পুনরায় মেরামত কাজ শুরু করা হয়েছে। এদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ গত ৭ জানুয়ারি তাদের জায়গা থেকে রেস্তোরাঁটি সরানোর জন্য চিঠি দিয়েছে পুলিশ সুপারকে। কিন্তু রেস্তোরাঁ ভবন সরানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না পুলিশ।
গাইবান্ধা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় সূত্র জানায়, গাইবান্ধা শহরের পশ্চিম কোমরনই এলাকায় ১.০৯ একর শতক জমি তৎকালীন জেল ডিপার্টমেন্টের নামে রেকর্ডভুক্ত ছিলো। এরমধ্যে ১৯৮৭ সালে ৭৯/১৯৮৬-৮৭ নম্বর এল এ কেস মূলে ৮ শতক জমি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ অধিগ্রহণ করে। অবশিষ্ট ১.০১ একর জমিতে গাইবান্ধা জেলা কারাগার ছিল। পরবর্তীতে কারাগারটি অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়।
জেলা কারাগারটি অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ায় উক্ত জমি (অবকাঠামো ব্যতীত) জেলা প্রশাসক, গাইবান্ধা মহোদয়ের পক্ষে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, খোলাহাটী গত ২০০৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দখল গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে উক্ত জমি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মিস কেস আদেশে রিজিম করে খাস খতিয়ান ভুক্ত করা হয়।
এদিকে গাইবান্ধা বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষে প্রধান শিক্ষক উক্ত তফশীলভূক্ত ১.০১ একর জমি দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের জন্য ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সহকারী কমিশনার (ভূমি) গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা বরাবর আবেদন করেন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে সরেজমিন তদন্ত এবং আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষে অকৃষি খাসজমি প্রচলিত নীতিমালার আলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাজার মূল্যের ১০% হারে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে গত ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট তারিখের সভাপতি বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের অনুকূলে বার্ষিক ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৯০ টাকা সেলামী গ্রহণ পূর্বক শর্তসাপেক্ষে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত প্রদান করেন। সেলামির টাকা জমা দানের পর ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের সভাপতি অনুমোদিত দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তকৃত ১.০১ একর জমির দখল গ্রহণ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ২০২১ সালে গাইবান্ধা জেলা ট্রাফিক পুলিশের কতিপয় সদস্য জোরপূর্বক সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের এবং গাইবান্ধা বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের জায়গা দখল করে চাইনিজ রেস্তোরা নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এতে বাঁধা দিলে কতিপয় পুলিশ সদস্যের পক্ষ থেকে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক এবং সওজ বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নানা ধরণের ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়া হয়। তারা সকল ধরণের বাধা উপেক্ষা করে দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের পর তৃতীয় তলার কাজ শুরু করে।
এ জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে জোর পূর্বক ১১ কেভি লাইন পুলিশ সদস্যরা তাদের নিজের মতো করে স্থাপন করে নেয়। তৃতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের প্রস্তুতির সময় ২০২১ সালের ১ জুন দিবাগত রাত ১২টার দিকে তৃতীয় তলায় উঠে মুঠোফোনে কথা বলার সময় জেলা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট ফয়সাল মামুন (৩১) ১১ কেভি তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। নিহত ফয়সাল মামুনের বাড়ি দিনাজপুরের সদর উপজেলায়।
ফয়সাল মামুন ২০১৭ সালে সার্জেন্ট হিসেবে ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেন। সার্জেন্ট ফয়সাল মামুনের মৃত্যুর পর তৃতীয় তলার কাজ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। পরে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত কাজ শেষ করে নিজ তলায় পুলিশ ব্যারাক ও দোতলায় চাইনিজ রেস্তোরা চালু করে তারা। রেস্তোরার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুলিশ ক্যাফে’। রেস্তোরাঁর সামনে সড়কের ফুটপাত ও ড্রেন দখল করে গাড়ি পার্কিং করা হয়।
এছাড়া রেস্তোরা ও পুলিশ ব্যারাকের টয়লেট ও কমোডের পয় নিষ্কাশনের সংযোগ দেওয়া হয় সরাসরি সওজ বিভাগের নির্মিত ড্রেনে মধ্যে। ফলে সড়ক সম্প্রসারণ সংকোচিত হয় এবং ‘পুলিশ ক্যাফে’ নির্মাণের কারণে পুরাতন জেলখানা মোড়ে গোল চক্করটি ছোট করে নির্মাণ কাজ শেষ করে সওজ বিভাগ। যে কারণে পুরাতন জেলখানা মোড়ে গোল চক্কর এলাকায় প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট বালাসি এলাকা থেকে আসা একটি ট্রাককে মোটর সাইকেল নিয়ে থামাতে ওভারটেক করার চেষ্টা করেন ট্রাফিক পুলিশ কনস্টবল বিপ্লব প্রামানিক। পুরাতন জেলখানা মোড়ে গোল চক্কর এলাকায় ট্রাকটি ডানে বাক নিলে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন কনস্টবল বিপ্লব প্রামানিক। ‘পুলিশ ক্যাফে’ নির্মাণের কারণে পুরাতন জেলখানা মোড়ে গোল চক্করটি ছোট হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ নিয়েও জনমনে ক্ষোভ রয়েছে।
অপরদিকে স্কুলের জায়গা দখল করে ‘পুলিশ ক্যাফে’ নির্মাণের কারণে স্কুলের ভবন সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সওজ বিভাগ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রেস্তোরাটি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। এরপর গায়ের জোড়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় কতিপয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। কিন্তু বাধার মুখে সংস্কার কাজ বন্ধ হয়।
গাইবান্ধা বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, স্কুলের জায়গা থেকে পুলিশ ক্যাফে রেস্তোরাঁ সরানোর জন্য জেলা পুলিশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। তারা সরানোর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার নিশাত এ্যাঞ্জেলা বলেন, আমি নতুন এসেছি। এ বিষয়ে কিছু জানি না। তবে পুলিশ ক্যাফেটি কার জায়গায়, তা খোঁজখবর নেওয়ার পর বলতে পারব। তখন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আরটিভি/এএএ
মন্তব্য করুন