১৯৭১ সালে দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের দামামার ঢোল বাজে তখন দেশের জন্য লড়াই করেছিল অসংখ্য শিশু-কিশোর। বয়সের কারণে মুক্তিবাহিনীতে তাদের জায়গা হয়নি সহজে! কিন্তু তাদের অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মেনেছেন তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা। এমনও ঘটেছে, রাইফেলটাও ঠিক মতো তুলে ধরতে পারে না, তবুও মুক্তিযুদ্ধে এসেছে। এমনই একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আবু সালেক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রণাঙ্গনে সাহসী ভূমিকার জন্য আজও মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গর্ব কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক মুক্তিযুদ্ধের ছবি রাইফেল হাতে অদম্য সাহসী কিশোরের সঙ্গে সবাই অতি পরিচিত। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক (বীর প্রতীক) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। রাইফেল হাতে এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ছবিটা নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, পোস্টারে, ফেস্টুনে কিংবা ক্যালেন্ডারে। সবার জানার আগ্রহ তিনি কি বেঁচে আছেন? নাকি শহীদ হয়েছেন? হ্যাঁ তিনি বেঁচে আছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৬৬ বছরে পা দিয়েছেন তিনি।
তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ২নং ধরখার ইউনিয়নের হাশিমপুর (ভাটামাথা) গ্রামে বসবাস করছেন। উনার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। দুই ছেলে প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছেন
কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক (বীর প্রতীক) মুক্তিযুদ্ধে অবদানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উচ্চ বিদ্যালয় ৭ম শ্রেণির ছাত্র ছিল আবু সালেক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বই খাতা ফেলে স্থানীয় গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের সহযোগিতায় ভারতের আগরতলায় চলে যায় আবু সালেক। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে লোক বাছাই চলছিল। কিন্তু আবু সালেক বয়স মাত্র ১২ বছর হওয়াতে কেউই যুদ্ধে নিতে চায়নি। বাছাইয়ে না টিকে কান্নায় ভেঙে পড়ে ছেলেটি। একপর্যায়ে নানা আকুতি মিনতি করে কান্নাকাটি-দেখে বাধ্য হয়ে উনাকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হলো দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের।
আবু সালেক জানান, আগরতলা থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আসামের গৌহাটি ক্যাম্পে। সেখানে প্রায় ৫০ জনের একটি টিম ভারতের আসামের গৌহাটিতে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় প্রায় ২১ দিন। প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় তাকে আগরতলার মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে মেলাগড়ে রেখে প্রশিক্ষকরা চলে যান। পরে মেলাঘর থেকে তৎকালীন ক্যাপ্টেন সাবেক সেনাপ্রধান আইনুদ্দিন, মেজর হায়দার, সেক্টর কমান্ডার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আগরতলার দুই নম্বর সেক্টরে বড় যোদ্ধাদের সঙ্গে শুরু করি দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ।
তিনি আরও জানান, এমনি একদিন ওরা ভীষণ যুদ্ধ করছিলো চন্দ্রপুর গ্রামে। আমি ছিলাম সেই যুদ্ধে বাঙ্কারে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। মুক্তিবাহিনীর একপর্যায়ে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো। এখন ওদের সামনে একটাই রাস্তা, পিছু হটতে হবে। আর পিছু হটতে হলে একজনকে তো ব্যাকআপ দিতে হবে। নইলে যে সবাই মারা পড়বে। তখন এগিয়ে গেলাম সবার ছোট কিশোর আমি আবু সালেক।
ছোট্ট কাঁধে তুলে নিলাম বিশাল এক দায়িত্ব। ক্রমাগত গুলি করতে লাগলাম পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। আর সেই অবসরে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেল অন্যরা। কিন্তু গুলি থামালো না। আমার গুলির ধরন দেখে পাকবাহিনী মনে করলো, মুক্তিযোদ্ধারা খুব সংগঠিতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। ফলে ওরাও পিছু হটে গেল। বাঙ্কারে থেকে গেলাম শুধু আমি। একসময় রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলো আমি নিশ্চয়ই শহীদ হয়েছে। কিন্তু বাঙ্কারে গিয়ে সবাই দেখল একা বাঙ্কারে বসে আছি।
ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মো. আকরাম আলী জানান, আমার গ্রামের এই দুঃসাহসী কিশোর বাংলাদেশের খেতাবপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। সেট আমার গ্রামের গর্ব নয় সারা বাংলাদেশের গর্ব। আমরা যুদ্ধ শেষে যখন বিজয় উল্লাস করছিলাম আমরা নিশ্চিত ছিলাম সে আর বেঁচে নেই কিন্তু পরে বাড়িতে এসে আমরা জানতে পারি সে বেঁচে আছে এমনকি তার খতম পর্যন্ত পড়ানো হয়েছিলো।
বীর প্রতীক আবু সালেকের নাতী হৃদয় জানান, বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা লেখি হয় যে, রাইফেল হাতে কিশোর মুক্তিযোদ্ধাটি বেঁচে নেই কিন্তু তিনি আলহামদুলিল্লাহ এখনও বেঁচে আছেন।
৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ২নং ধরখার ইউনিয়নের হাশিমপুর (ভাটামাথা) গ্রামের এই দুঃসাহসী কিশোর বাংলাদেশের খেতাবপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক বাবা চাচাসহ ৩৩ জন সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার তীব্র প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তার রয়েছে পাকিস্তানি ক্যাম্পে বারবার গেরিলা আক্রমণের বীরত্বপূর্ণ অবদানের ইতিহাস।
আরটিভি/এএএ