রাজশাহী স্টেশন আধুনিক হলেও লোকবলের সংকট রয়েছে পশ্চিমাঞ্চল রেলে (ভিডিও)
ভৌগলিক অবস্থান ও যুগের চাহিদায় রাজশাহীর রেলপথ ও স্টেশন স্থাপিত হয় ১৯৩০ সালে। বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল হেড কোয়ার্টার রাজশাহীতে হওয়ায় সবসময় গুরুত্ব পায় রাজশাহী রেলস্টেশন। এ স্টেশনের যাত্রী সেবার মান, টিকিটিং সিস্টেম, সময়মতো ট্রেন ছাড়াসহ স্টেশনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকলেও আরও আধুনিকতার ছোঁয়া আগামীতে লাগতে যাচ্ছে বলে জানান রেলের কর্তা ব্যক্তিরা। তবে পশ্চিমাঞ্চল রেলে লোকবলের সংকটের কারণে প্রায় ৫০টি স্টেশনে যাত্রী সেবায় ঘাটতি রয়েছে। আর রেলের শিডিউল বিপর্যয় ও কিছুদূর পরপর ক্রসিংয়ের কারণে ট্রেন থেমে যাওয়ায় সময়মত গন্তব্যে পৌঁছতে পারছেন না রেল ভ্রমণকারী যাত্রীরা।
রাজশাহীর ঐতিহ্য ও কৃষ্টি কালচার নিয়ে গবেষণারত মাহাবুব আলম সিদ্দিক্কী জানান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগের কারণে ব্রিটিশ সরকারের নর্দান বেঙ্গল অ্যাস্টেট রেলওয়ে তৈরি করে আব্দুলপুর থেকে আমনুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন ও রাজশাহী রেলস্টেশন। একই সময়ে নন্দনগাছী, আড়ানী ও সরদাহ রোড স্টেশন তৈরি হয়। রাজশাহী স্টেশন থেকে সে সময়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের চেয়ে মাল আনা নেয়ার গুরুত্ব ছিল বেশি। সে আমল থেকেই এ অঞ্চলে সবজিসহ অন্যান্য ফসল এখান থেকে কলকাতাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যেত আর সেখান থেকে খুব সহজেই এ অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিষ রেল যোগাযোগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছতো। ফলে খুব তাড়াতাড়ি রাজশাহীর বাণিজ্যিক ও সাস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটতে থাকলো। এ ছাড়াও সে সময় থেকেই রাজশাহী শিক্ষা নগরী হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে খুব সহজেই আসতে পারতো শিক্ষার্থীরা। প্রথম দিকে রাজশাহী স্টেশন থেকে লোকাল ও মেইল মিলে চারটি ট্রেন চলাচল করতো। রাজশাহী স্টেশনের প্রথম স্টেশন মাস্টার হিসেবে ছিলেন জ্ঞনতাপস ইবনে গোলাম সামাদের পিতা ইয়াসিন।
ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকা থেকে রাজশাহী রেল স্টেশনে জনসভায় অংশ নিতে আসেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি জানান, আশির দশকে শুরুতে রাজশাহীতে গড়ে ওঠে পশ্চিমাঞ্চল রেলের হেড কোয়ার্টার তার পর থেকেই দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে রাজশাহী রেলের এবং ২০০৩-৪ সালে স্টেশনটি রিমডেলিং এর কাজ সম্পূর্ণ হলে নতুন রূপ পায় রাজশাহী রেল স্টেশনটি। এরপর কলেবর বৃদ্ধি হয়, বৃদ্ধি হয় লোকবল। আস্তে আস্তে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সমস্য দূর হতে থাকে এবং বর্তমানে রাজশাহী রেল স্টেশনটি বাংলাদেশের মধ্যে একটি মডেল রেলস্টেশন।
রেলের যাত্রীরা সেবার মানে খুশি হলেও যাত্রীরা জানান, রেল যাত্রা এখন মানুষ বেশি পছন্দ করে কিন্তু শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এছাড়াও বনলতা নন-স্টপ ট্রেন হওয়ার পরও অনেকগুলো স্টেশনে থেমে যায় ফলে সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছে না সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া দরকার।
রাজশাহী রেলের সাবেক প্রধান পার্সেল সহকারী রাব্বীল আলী জানান, আমি এই স্টেশনে ২৮ বছর চাকরি করেছি যত দিন গেছে ততই এই স্টেশনের পরিবর্তন দেখেছি। আগে এই স্টেশনের প্লাটফর্ম নিচু ছিল। ট্রেনে উঠতে হলে ক্লাইম্বিং করে অনেক কষ্ট করে ট্রেনে উঠতে হতো। বর্তমানে স্টেশনটি রিমডেলিং হওয়ার পর এক কদম ফেললেই যে কেউই ট্রেনে উঠতে পারে। অতীতের সেই দুই রুমওয়ালা স্টেশন বদলে এখন রাজশাহী স্টেশনের বর্তমানকে অনুকরণ করা যায় বলে মনে করেন তিনি।
এখানে রয়েছে ডিজিটাল বোর্ডে বর্ণমালার ক্রমানুসারে বগি নাম্বার, মাতৃদুগ্ধ কর্নার, নামাজ ঘর, বিভিন্ন শ্রেণির যাত্রীদের বিশ্রামাগারসহ প্লাটফর্মে বসার চেয়ার রয়েছে। পরিষ্কারর পরিছন্নতার দিক দিয়েও রয়েছে এ স্টেশনের সুনাম। অন লাইনসহ কাউন্টারের মাধ্যমে টিকিট প্রাপ্তির ব্যবস্থা। বর্তমানে রাজশাহী রেল স্টেশন থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার যাত্রী প্রতিদিন বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। এ স্টেশন থেকে মোট ২৪ জোরা আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এছাড়াও এ রেল স্টেশনে কমিউটার ও লোকাল ট্রেনও চলাচল করে বিভিন্ন রুটে। ৮০ দশকের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে রাজশাহী স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা। এ কারণে রেললাইন বৃদ্ধির কাজও চলছে এ রেলস্টেশনে বলে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজশাহী স্টেশনের প্রথম স্টেশন ম্যানেজার আব্দুল করিম।
এদিকে রাজশাহী স্টেশনসহ পশ্চিমাঞ্চল রেলের আরও আধুনিকায়ন হতে যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে কোচ আনা হচ্ছে, লোকমোটিভ আনা হচ্ছে, ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে, নতুন নতুন স্টেশন বাড়ছে কিন্তু জনবল সেভাবে বাড়ানো হচ্ছে না। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনবল বৃদ্ধি করে ৫০টির অধিক স্টেশনের যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি, হাইস্পিড ট্রেন চলাচল করতে পারবে এমন লাইন স্থাপনসহ রাজশাহী-কলকাতা সরাসরি ট্রেন চালুর সম্ভাবনার কথা রয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলের সমস্ত লাইন ও ব্রিজ সংস্কার ও নতুনভাবে তৈরির প্রস্তাবনা তৈরি হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হলে ট্রেন কানেকশন চালু হবে বলে জানান বাংলাদেশ রেলেওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জিএম মিহির কান্তি গুহ।
তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনের জন্য শিগগিরিই ১০টি ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। ফলে ভারতীয় পণ্য আরও বেশি পরিমাণে আমদানি করা যাবে। তিনি জানান বঙ্গবন্ধু সেতুরে ওপর দিয়ে যেখানে ২৪টি ট্রেন যাতায়াতের ক্যাপাসিটি রয়েছে সেখানে এখন চলাচল করে ৪২টি ট্রেন। অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি ট্রেন চলাচলের কারণে শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। এই অবস্থায় সরকার দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রথম পিলার আগামী ১৭ মার্চের পূর্বে উদ্বোধন করবেন ফলে আগামীতে এ সেতুটি নির্মাণ হলে পশ্চিমাঞ্চল রেলের গতিশীলতা ও পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
জেবি
মন্তব্য করুন