সত্যি সত্যি স্বপ্নের রাজকন্যার দেখা পেতে সাত সাগর আর ১৩ নদী পাড়ি দিয়ে জার্মান গিয়েছিলেন বাংলাদেশের তরুণ প্রকৌশলী হাবিব।
শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই রূপনগরের রাজকন্যার দেখাও পেয়ে যান সেখানে। আর সেই রূপনগরের রাজকন্যা যেন বসে ছিলেন সাগরের তীরে বনলতা সেনের মতো।
হাবিবের উদ্দেশে বেলারুশের তরুণী নাতালিয়া বললেন, এত দিন কোথায় ছিলেন? হাবিবের সঙ্গে পরিচয়ে যেন অনেক শান্তি পেয়েছিলেন নাতালিয়া। ভালোবাসার এমন গল্প বাংলাদেশি ছেলে হাবিব ও বেলারুশের মেয়ে নাতালিয়ার। প্রেম মানে না কোনো বাধা, মানে না কোনো জাত কিংবা দেশের সীমান্ত। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হাবিব-নাতালিয়া দম্পতি।
বাংলাদেশের ছেলে হাবিব রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মান যান। জার্মানির বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ স্টেডিয়ামে স্টুডেন্ট জব করতে গিয়ে হাবিবের সঙ্গে পরিচয় হয় বেলারুশের মেয়ে নাতালিয়ার। ধীরে ধীরে তা বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে রূপ নেয়। দুজন দু’দেশের হলেও একে অপরের প্রতি প্রেমের টান, আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে বন্ধন গড়ে তোলেন। ৪ বছরের প্রেম শেষে ২০১৭ সালের ৯ জুলাই বিয়ে করেন। তাদের দুই বছরের মেয়ে নাদিয়া। বর্তমানে তারা জার্মানির পূর্বাঞ্চলের সাক্সনি অঙ্গরাজ্যের কেমনিজ শহরে বসবাস করছেন। জানুয়ারিতে দেশে এসে বাংলাদেশি রীতিতে গায়েহলুদ ও বিয়ের আয়োজন করেন।
বাংলাদেশ সফরে এসে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন এই দম্পতি। জার্মানিতে দীর্ঘ লকডাউনের একঘেঁয়েমি কাটাতে সখের বশেই, ২০২০ সালের অক্টোবরে ‘নাতালিয়া অ্যান্ড হাবিব-দ্যা মিক্স ম্যাচ ফ্যামিলি’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ খোলেন। নাতালিয়ার ভাঙা ভাঙা বাংলা ও তার বাংলা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের মেয়ে ছোট নাদিয়ার সরব উপস্থিতি, অল্পদিনেই তাদের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় হাবিব-নাতালিয়া। কথা বলেছেন আরটিভির সঙ্গে।
ভিন্ন দেশের হওয়ার পরও নাতালিয়াকে পছন্দ করার কারণ কী?
হাবিব : আমি মনে করি সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশ কোনো বাধা হতে পারে না। নাতালিয়ার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি। নাতালিয়া কোন দেশের এটা আমার কাছে মুখ্য না। নাতালিয়া ভীষণ ভালো একটা মেয়ে, অনেকটা আবেগপ্রবণ। ওর ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ। আমাকে অনেক ভালো বোঝে। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা অনেক ভালো। আমাদের সম্পর্কের গভীরতা এতটা ছিল যে, নাতালিয়া অন্য দেশের কখনো মনে হয়নি। সেই অনুভূতি থেকেই আমি বুঝতে পারি জীবনসঙ্গী হিসেবে নাতালিয়া আমার জন্য ঠিক আছে।
হাবিবের কোন বিষয়গুলো আপনাকে আকৃষ্ট করে?
নাতালিয়া : হাবিব খুবই রোমান্টিক একটা ছেলে। মানুষের সঙ্গে খুব সহজে মিশতে পারে। হাবিবের সঙ্গে মিশে আমি বুঝতে পারি, সে অত্যন্ত সৎ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি। আমার ভালো থাকার জন্য হাবিব সবকিছু করতে পারে। বাংলাদেশি ছেলেরা ভীষণ আন্তরিক ও দয়ালু। যা আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে।
প্রথমবার বাংলাদেশ সফর করে কেমন লাগল?
নাতালিয়া : বাংলাদেশে এসে ভীষণ একসাইটেড আমি। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে প্রথমবার দেখে এবং তাদের সঙ্গে মিশে এত ভালো লেগেছে যে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমাকে খুবই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে হাবিবের পরিবার। তবে খারাপ লেগেছে, আমার শ্বশুর মারা গেছেন গত বছর। তার সঙ্গে দেখা হলো না। এটা আমার জন্য অনেক কষ্টের। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় আমি কৃতজ্ঞ। এখানে এসে নতুনভাবে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান, বাংলাদেশের মতো বিয়ের প্রোগ্রাম। এটা একেবারেই ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের গায়েহলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠান সত্যি ভিন্ন রকম। পোশাক সাজগোজ এসব কিছু মিলিয়ে অপূর্ব এক অনুভূতি হয়েছে। যা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নাতালিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশে এসে কেমন লাগল?
হাবিব : আমি কখনো কল্পনা করিনি বাংলাদেশে আমাদের এত ভক্ত আছে। এত মানুষের ভালোবাসায় আমি অভিভূত ও কৃতজ্ঞ। নাতালিয়া তো প্রথমে আমার মা-ভাই-ভাবিসহ পরিবারের লোকজনকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে আমার পরিবারের মানুষকে ভীষণ আপন করে নিয়েছে। আমাদের গায়েহলুদের অনুষ্ঠান, বিয়ের প্রোগ্রামে বউ সাজাসহ সবকিছু ভীষণ উপভোগ করেছে। গ্রামের পরিবেশ মানুষের আন্তরিকতায় সে মুগ্ধ হয়েছে। যেখানেই নাতালিয়া গিয়েছে তাকে দেখার জন্য মানুষ ছুটে এসেছে। এটা আমার জীবনের অন্যতম একটা পাওয়া।
আপনাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্য কী?
হাবিব : আসলে প্রেম বা ভালোবাসার ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশ বা ভিন্ন সংস্কৃতি কোনো বাধা হতে পারে না। ভালোবাসার জন্য শুধুই ভালো মন প্রয়োজন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস এবং একে অন্যকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি যেমন নাতালিয়ার ভালো লাগা বা মন্দ লাগাকে বুঝি, তেমনি নাতালিয়াও আমার সবকিছুকে গুরুত্ব দেয়। জার্মানিতে থাকলেও প্রতিনিয়ত নাতালিয়া আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তাই আমাদের আত্মার বন্ধনটা অনেক দৃঢ়। আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি যে নাতালিয়ার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। আমাদের পেশাগত জীবনের বাহিরে সন্তান লালন-পালন করি। নিজেদের সংসারের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করি।