দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হায়দার হোসেন। মূলত সমাজ, মানবতা ও দেশের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে গান করে থাকেন তিনি। তার গাওয়া ‘তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি’ ও ‘চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়াও করিতে পারিনি চিৎকার’ গান দুটি এখনও দাগ কেটে আছে দর্শক-শ্রোতাদের মনে।
গুণী এই সংগীতশিল্পী গানের জগতের সমসাময়িক নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আরটিভির সঙ্গে।
আরটিভি : কেমন আছেন?
হায়দার হোসেন : আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো।
আরটিভি : আপনাকে বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে গান গাইতে দেখেছি, এখন তেমনটা পাওয়া যাচ্ছে না, এর কারণ কী?
হায়দার হোসেন : আগের মতো তো আমার বয়স নেই। এখন আর এত লাফালাফি চাপাচাপিও করতে পারি না। আর গান করা এত সহজ না। অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। আমি হয়তো ওইভাবে এখন করতে পারি না। যে কারণে আমার কাছে কঠিন মনে হয়। একটা গান করার অর্থ হলো প্রোপার স্টুডিও লাগবে। আমার মিউজিশিয়ান থাকতে হবে। সেই মিউজিশিয়ানকে আমি বলে দেব, তাকে সেভাবে বাজাতে হবে। বর্তমানে এগুলোর সমন্বয় এবং অভাব এত বেশি হয়েছে যে, আমাদের মতো মানুষের এখন গান করা খুব মুশকিল হয়ে গেছে।
আরটিভি : বাংলাদেশের সংগীত জগতে বড় একটি পরিবর্তন এসেছে ক্যাসেট থেকে সিডি, সেখান থেকে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম। এ ক্ষেত্রে আপনি নিজেকে কতটুকু রূপান্তর করেছেন?
হায়দার হোসেন : আমরা রূপান্তর হব কেন? আমরা তো গান করি। গান তৈরি করা আমাদের কাজ। গানকে নিয়ে ফেরি করা কিন্তু আমাদের কাজ না। এটা যারা ফেরিওয়ালা তারা ফেরি করবে আর আমরা গান করব।
আরটিভি : বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির এখন যে অবস্থা এর ভবিষ্যৎ কী?
হায়দার হোসেন : আমি এখন মিউজিক শুনি না। তাই এই ব্যাপারে কথা বলাটা আমার জন্য অনেক কষ্ট হয়ে যায়। আসলে আমরা তো অ্যানালগ মানুষ, ডিজিটাল না। তোমরা যেভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভর করেছ ওইটা দিয়ে কিছু হবে না। ওইটা দিয়ে রোবট হয়। সেদিন আমাদের একটা মিটিং ছিল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানে আমার বক্তৃতা ছিল। বাইরে থেকে অনেক গুণী মানুষ এসেছিলেন। তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে অনেক দাম দিয়েছেন। কিন্তু আমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে বলেছি নাথিং। একটি লাইব্রেরিতে প্রচুর বই আছে, তুমি রেফারেন্সে খুঁজে পাবে। কিন্তু বর্তমানে এই লাইব্রেরিটাকে কী করেছি আমরা ছোট্ট একটি সফটওয়্যারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তুমি শুধু সেটাকে কন্ট্রোল করবা। ও তো নিজে থেকে কিছু বলতে পারবে না। এটা হিউম্যান বিং যে আউট অব বক্স থেকে চিন্তা করতে পারে, লিখতে পারে। প্রথমে তো আউট অব বক্সটা কী, সেটা তোমাকে চিনতে হবে।
এখনকার বাচ্চাদেরকে আমি দেখি তারা শুরুই করেছে কপি করে। তুমি যদি কপি করে মিউজিক করো তাহলে তোমার তো সেই নিজস্বতা থাকবে না। তুমি সবসময় পিছিয়েই থাকবে। কারণ, তুমি আরেকজনকে কপি করছ, তুমি তার আগে যেতে পারবে না। এটা একটা প্রবলেম। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মিউজিক তো সহজ বিষয় না। কোনো মানুষ চাইলেই তো মিউজিশিয়ান হতে পারে না। আর মিউজিক ডিরেক্টর হওয়া তো প্রশ্নই আসেনা। যে কোনো মানুষ গায়ক-গায়িকা হতে পারবে না। তার এক্সট্রা একটা ট্যালেন্ট থাকতে হবে। শুধু পাঁচ বছর কোর্স করলেই গায়ক-গায়িকা হবে এটাও মিথ্যা কথা। পাঁচ কেন ২৫ বছর কোর্স করলেও পারবে না। গান গাওয়ার জন্য একটা ট্যালেন্ট তোমার লাগবে যেটা দিয়ে তুমি সংগীতশিল্পী হতে পারবে। এখন মেলোডিন দিয়ে গলায় সুর করে গান করছে। এখানে তার তো লজ্জা হওয়া উচিত। যে আমি এই কাজ করছি কেন। সেই লজ্জা কি আছে? সেই জায়গা থেকে ওদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করছি না।
আরটিভি : আমরা এখন ধীরে ধীরে মেধাহীন হয়ে যাচ্ছি, সংগীতের এই যে সংকট চলছে এখান থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আছে কিনা?
হায়দার হোসেন : মেধাহীন কি শুধু সংগীতে দেখছি আমরা। না, এখন একটা সফটওয়্যার আছে, ইউনিভার্সিটিতে তোমাকে কিছু লিখতে দিয়েছে তুমি ওকে প্রশ্ন করবে, তোমাকে ও লিখে দেয়। তুমি শুধু সেটা নিয়ে সাবমিট করো। প্রযুক্তি অবশ্যই ভালো একটা জিনিস। যেমন গাড়ি একটি ভালো জিনিস কিন্তু তার মানে কি এই যে আমি হাঁটা ভুলে যাব। গাড়ি আছে বলেই হাঁটতে পারি না। এটা তো ঠিক না। আমাকে হাঁটতে হবে পাশাপাশি গাড়িও ব্যবহার করতে হবে। প্রযুক্তি অবশ্যই আমাদের কাজে লাগবে যদি সেটা প্রোপারলি ব্যাবহার করা হয়। এখন প্রযুক্তিকে যদি তুমি মেলোডিন হিসেবে তুমি ব্যবহার করো নিজের গলা ঠিক করার জন্য। তুমি তাল পারো না, তোমাকে তালে তালে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রযুক্তি তো আমার মতে সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।
আরটিভি : যুগের তালে সংগীতে পরিবর্তন আসছে? এই পরিবর্তনের ধারায় আমরা কী আমাদের সেই স্বর্ণালী যুগটা সংগীতের ক্ষেত্রে ফিরে পাব?
হায়দার হোসেন : এটা আজীবন পাব আমরা। যখন এই ধরনের জিনিসগুলো উড়তে থাকবে তখন একটা সময় মানুষ ফেড-আপ হয়ে যাবে। তখন গান শোনা তো দূরের কথা একটা কনসার্টেও মানুষ যাবে না। একটা সময় এমন দিন আসবে। তখন কী হবে? আবার যারা গান ভালো করত তাদের দাম চলে আসবে। এটা ইভালুয়েশনের মতো ঘুরতে থাকে। কখনও পপ সংগীত নাম করছে, কখনও ফোক কিংবা ক্লাসিক্যাল নাম করছে।
আরটিভি : কোক স্টুডিওর যে ফিউশনধর্মী নিয়ে যে গানগুলো আসে সেগুলো আপনি কী সমর্থন করেন?
হায়দার হোসেন : আমার আসলে এসব বিষয়ে খুব একটা কথা বলা হয় না। আমি একটি গান তৈরি করেছি ‘ইউ হেভ নো রাইট টু চেঞ্জ এনিথিং’। এটা আমার হিসাব। আমি যদি মিউজিক ডিরেক্টর হই, আমি যা বাজিয়েছি তাই বাজাতে হবে। আর যদি বাজাতে চায় তাহলে আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে করতে হবে। যদি অনুমতি নিয়ে করে থাকে তাহলে ঠিক আছে। আর সেটা না নিয়ে করে তাহলে তারা যতোই ভালো করুক না কেন আমি বলব ঠিক হয়নি। কারণ তোমার সেই রাইট নেই, আমার গানের কোনো লাইন তুমি পরিবর্তন করতে পারবে না। আমি গানের যে পিচ বাজিয়েছি সেটা তুমি পরিবর্তন করতে পারবে না। আমাকে সম্মান করতে হবে। কোক স্টুডিওতে কি ভালো গান হয় না? ভালো গানগুলো তো আমার শুনতে ভালো লাগে। সব গান যে ভালো হয় তা কিন্তু নয়।
আরটিভি : আপনার বর্তমান ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম?
হায়দার হোসেন : আমি তো কাজই করছি না। আমি এত অলস একটা লোক। তাই এখন কোনো কাজ করা হচ্ছে না।
আরটিভি : ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া, করিতে পারিনি চিৎকার’ আপনার জনপ্রিয় একটি গান, সামনে কি এই ধরনের আর কোনো গান শুনতে পাব আমরা?
হায়দার হোসেন : আমি আসলে এই ধরনের গান আর লিখতে চাই না। এসব গান আমাকে লিখতে হবে কেন? আমাকে বাধ্য করা হয় বলে লিখি। আমার দেশে যেন এই ধরনের ঘটনা না হয়, আর আমাকেও যেন লিখতে না হয় আমি সেখানে আছি। আমি একটি সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে চাই।