বৈশাখের ‘মেলায় যাইরে’ গান তৈরির পেছনের গল্প
পহেলা বৈশাখ এলেই চায়ের দোকান থেকে শুরু করে যেকোন আড্ডায় বাজতে শোনা যায় ‘মেলায় যাইরে মেলায় যাইরে’ গানটি। গানটি ১৯৯০ সালে জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাকের একটি অ্যালবামের শিরোনাম সংগীত হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছিল। গান তৈরির হিসেবে এবার ৩৪ বছর হতে চলছে। গানের বয়স বাড়লেও এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও।
বৈশাখের এই গানের সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী মাকসুদুল হক। ১৯৯০ সালে গানটি যখন প্রকাশ পায় তখন তিনি যুক্ত ছিলো জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাকের সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে ফিডব্যাক ছেড়ে ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ড গড়ে তোলেন মাকসুদুল হক। কীভাবে গানটি তৈরি হয়েছিল, সেই গল্প শুনিয়েছিলেন গানটির স্রষ্টা মাকসুদ।
মাকসুদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, গানটি লিখি ১৯৮৮ সালে । প্রথমত গানটি আমি একবারে লিখতে পারিনি। আমার সময় লেগেছিল দুই মাস। লেখার পর সাত-আটবার সংশোধন করেছি। এরপর সুর করেছি। স্টেজে আমরা গানটা পারফর্ম করাও শুরু করি। গানটি রেকর্ডিং একদিনে হয়নি। অনেক সময় লেগেছে। আমরা সেই সময় ডিজিটালে রেকর্ডিং করেছি। সেজন্যই সময় বেশি লেগেছিল। ঢাক, ঢোল, মন্দিরার শব্দ লাইভে বাজানো সম্ভব নয়। ব্যান্ডের সদস্যদের সঙ্গে আমাদের কথা কাটাকাটি কত কিছু যে হয়েছে। রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়েও বেগ পেতে হয়েছে অনেক। পুরো গান তৈরি হতে প্রায় এক থেকে দেড় বছর সময় লেগেছিল।
গানের জন্মকথা প্রসঙ্গে মাকসুদ দেশের এক পত্রিকায় তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, কত সময় ব্যয় করে এর কথা লিখেছি, তার সঠিক হিসাব-নিকাশ হয়তো এখন দেওয়া সম্ভব নয়। এটুকু মনে আছে, গানে সেই চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছি, যা প্রতি বৈশাখে আমাদের চোখে পড়ে। অনেক শব্দের কাটিকুটি শেষে বেরিয়ে এসেছিল কিছু ছন্দোবদ্ধ কথা। লেখা শেষে নিজেই তাতে সুর বসিয়েছি। এরপর ফিডব্যাকে সদস্যদের সঙ্গে বসেছি কম্পোজিশন নিয়ে। বাদ্য বাদনেও অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এরপর কণ্ঠে তুলি নিয়েছি গান। গেয়েছি মনপ্রাণ উজাড় করে, লেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে এ কি মাতন দোলা, লেগেছে সুরেরই তালে তালে হৃদয়ে মাতন দোলা; বছর ঘুরে এলো আরেক প্রভাতে, ফিরে এলো সুরেরই মঞ্জরি; পলাশ শিমুলগাছে লেগেছে আগুন, এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি, মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে...। স্টুডিওতে গিয়ে রেকর্ড করা পর্যন্ত একটি গানের পেছনে কত সময় ব্যয় করতে হয়, তার লেখাজোখা থাকে না। কারণ, সংগীত কোনো কাজ নয়, একধরনের সাধনা। যারা গান করেন, তারা ভালো করেই জানেন, প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কতটা শ্রম-ঘাম ঝরাতে হয়। যা হোক, “মেলা” গানটি রেকর্ড করার পর আমি, ফোয়াদ নাসের বাবু, পিয়ারু খান, লাবু রহমান, সেকেন্দার আহমেদ খোকা—প্রত্যেকেই অন্য রকম এক সৃষ্টির স্বাদ পেয়েছিলাম।
১৯৮৮ সালে চট্টগাম মেডিকেল কলেজ হলে ফিডক্যাকের প্রথম কনসার্টে ‘মেলায় যাইরে মেলায় যাইরে’ গানটি প্রথম গাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে মাকসুদ বলেন, সেই কনসার্টে আমরা প্রথম এই গান গাই। একেবারে নতুন গান। কিন্তু এটা শোনার পর ডাক্তার ও ছাত্র সবাই একসঙ্গে নেচেছে। সবার অনুরোধে সেদিন এই গান আমাদের দুবার গাইতে হয়েছিল।
নব্বই দশকে যখন গানটি তুমুল জনপ্রিয় তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখ করে এই জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী বলেন, ১৯৯২ সালে তো ল্যান্ডফোন ছিল । এক ভদ্রমহিলা বাসার ল্যান্ডফোনের নাম্বারে বারবার ফোন করেছিলেন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। যখন ফোন করতেন আমাকে তিনি বাসায় পেতেন না। আমার স্ত্রী এটা বলার পর একদিন আমি সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনার কাছে এই গান কি আমি জানি না। তবে আমার কাছে এই গান অনেক কিছু। আমার কোলে তিন মাস বয়সী শিশু এখন। তাকে কিছুতেই দুধ খাওয়ানো যেত না। অনেক কষ্ট হতো। একদিন আপনার গানটা ঘরে বাজছিল তখন আমার বাচ্চা হঠাৎ করেই দুধ খাওয়া শুরু করল। এখন এই গান না শুনলে আমার বাচ্চা দুধ খায় না। এই কথা শোনার পর আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি চলে এসেছিল। এখন মনে হয়, এটুকু ভালো কাজের জন্য ঈশ্বর আমাকে দিয়ে গানটা করিয়েছিলেন। সবার এসব ভালোবাসার আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় যে ‘মেলায় যাইরে’ কত হাজার লোক তালি দিল, নাচল।
মন্তব্য করুন