• ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
logo

এক মহাজীবনের সান্নিধ্যে কিছু দুর্লভ মুহূর্ত

  ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:২৯

দুই যুগ পেরিয়ে গেছে সাংবাদিকতার বয়স। এই লম্বা সময়ে মনে রাখার মতো প্রাপ্তি হলো কিছু মহাজীবনের সান্নিধ্য, যাদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ। কখনো দখিন হাওয়া কখনো নুহাশপল্লী, হুমায়ুন স্যারের সঙ্গে বহুবার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছি একাধিকবার। পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও হুমায়ূন আহমেদের সম্মোহনী কথার আসরে হাজির থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, পছন্দও করতেন।

মাত্র ৬৪ বছর আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা ক্ষণজন্মা এই মনীষির জন্মদিন আজ। হুমায়ূন আহমেদের ৭৬ তম জন্মদিনে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার সঙ্গে কাটানো কিছু দুর্লভ মুহূর্ত স্মরণ করছি।

ঠিক কবে কখন হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন বইটি পড়েছিলাম মনে নেই। মনে আছে, বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে বসে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখার কিছু টুকরো স্মৃতি। ১৫ দিন পর পর ধারাবাহিকটির একেকটি পর্ব প্রচার হতো। যেদিন বিটিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখানো হবে, সেদিন আমাদের পরিবারে আগে থেকেই শুরু হতো প্রস্তুতি। খুব সম্ভবত রাত ৯টায় দেখানো হতো ধারাবাহিকটি। আগে ভাগেই সেদিন রাতের খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ করে আমাদের ৬ সদস্যের পরিবারের সবাই বসতাম টিভি সেটের সামনে। মনে পড়ে নাটকটির টুনি চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনাটি। মা-বাবা দুজনের চোখেই দেখেছিলাম জল।

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছি। হঠাৎ কানে ভেসে উঠল ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। বইখাতা আর বাবার চোখ রাঙানি ভুলে দে ছুট। বিশাল মিছিল। মিছিলে লোকজন কেবল বাড়ছে। সবার সঙ্গে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দিলাম ‘বাকের ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’।

তারপর কত নাটক আর কত উপন্যাস! কলেজ জীবনে পরিচয় হলো হিমুর সঙ্গে। ইচ্ছে হলো, আমিও হিমু হই। ওমা শুধু কী আমি, সহপাঠী অনেকের মধ্যেও দেখলাম হিমুর প্রচণ্ড প্রভাব।

সাংবাদিকতা শুরু করি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায়, আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল ছিল অন্যদিন। এ পত্রিকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশ, যেখান থেকে হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে হুমায়ূনের তৃতীয় ছবি ‘দুই দুয়ারী’ নিয়ে একটি কভার স্টোরি তৈরির। সেটা ছিল ১৯৯৯ সাল। প্রথম সুযোগ হয় হুমায়ূন আহমেদের মুখোমুখি হওয়ার।

প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারে কেবল ‘দুই দুয়ারী’ আর নাটক-চলচ্চিত্র প্রসঙ্গেই কথাবার্তা হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমি মুগ্ধ। যথাসময়ে কভার স্টোরি বের হলো। সময় এলো ‘দুই দুয়ারী’ মুক্তির।

ছবি মুক্তির ঠিক আগের দিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের রুমে আমার ডাক পড়ল। ভিতরে ঢুকে দেখি বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনিই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললেন, তোমার লেখা কাভার স্টোরি আমার পছন্দ হয়েছে। কাল তো ছবি মুক্তি পাচ্ছে। তুমি এত সুন্দর একটা লেখা তৈরি করলে, ছবি মুক্তি পাবে আর তুমি দেখবে না, তা হয় না। পকেট থেকে দুইটা টিকিট বের করে দিলেন। মধুমতি সিনেমা হলের টিকিট।

বললেন, বিয়ে করেছো?

- জ্বি না, করিনি।

- প্রেম করো?

- আসলে সেইভাবে …

- এই বয়সে প্রেম না করলে আর কবে করবে? একটা টিকিট তোমার জন্য আরেকটি টিকিট তোমার প্রিয় কারও জন্য।

এই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর অনেক দিন পর হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সাক্ষাৎকার নিতে তার দখিন হাওয়ার বাসায় যাই। অ্যাপয়েনমেন্ট করা ছিল শাওনের সঙ্গে। ড্রয়িং রুমে বসে আছি। হুমায়ূন আহমেদ এলেন।

আমি জানতে চাইলাম, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তুমি কী আমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নিতে আসছো?

- জ্বি না স্যার… এমনিই…

- তোমার নাম বিপুল হাসান। বিপুল মানে বিশাল। পৃথিবীতে এসেছো, নামকরণে স্বার্থকতা প্রমাণ করে যাবে, ঠিক আছে?

কী আশ্চর্য, মাত্র একবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর থেকেই আমার মতো অভাজনকে তিনি মনে রেখেছিলেন। এরপর কতবার চাকরি বদল... অন্যদিন, ভোরের কাগজ, আনন্দ আলো, বাংলানিউজ। হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে কিংবা তার সৃষ্টি নিয়ে স্টোরি করার জন্য সময় চাইলে তিনি কখনও বিমুখ করেননি। এমনকি জানতেও চাননি কোন পত্রিকার জন্য কাজটি করছি।

এমনও হয়েছে ধানমন্ডির দখিন হওয়া কিংবা গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীতে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেছি। কিন্তু হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আড্ডায় বসে তার সম্মোহনী কথোপকথনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভুলে গেছি কী কাজে সেখানে যাওয়া!

একবার গেলাম নুহাশ পল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদ তখন সবেমাত্র ওষুধি গাছপালা চাষাবাদ শুরু করেছেন। দেখলাম গাছপালা নিয়ে তার ভীষণ উৎসাহ। আমাদের নিয়ে গেলেন তার সেই বাগানে।

- এটা হলো উলট কম্বল। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এ গাছের ডালপালা বেটে রস দিয়ে শরবত খেলে মুহূর্তেই মামলা খালাস।

- জ্বি, স্যার।

- এখন পর্যন্ত ১৩৪টি গাছ লতাপাতা সংগ্রহ করেছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কোনো বাগানে একসঙ্গে এত ওষধি গাছপালা নেই।

হঠাৎ স্যার বলে ওঠলেন, ‘মানুষের চেয়ে গাছ অনেক বেশি ভাগ্যবান!’ মনে মনে বলি, এ কেমন কথা? গাছরা বেশি ভাগ্যবান হয় কী করে?

ব্যাখ্যা দিলেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। বললেন, ‘এটা টের পাবে প্রতি বসন্তে। দেখো, বছর বছর বসন্ত আসে। কৃষ্ণচূড়া লালফুলে ছেয়ে যায়, আমগাছে মুকুল আসে, গাছে গাছে নতুন করে কচিপাতা গজায়। এর মানে বসন্ত এলে বৃক্ষরা ফিরে পায় নতুন যৌবন। প্রতি বসন্তেই গাছপালা যৌবন ফিরে পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষের জীবন থেকে একবার যৌবন চলে গেলে আর ফিরে আসে না।’

সেদিন স্যারের এ কথা শোনার পর অ্যাসাইনমেন্টের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে আক্ষেপ, বৃথাই এ মানবজীবন। কেনো বৃক্ষ হয়ে পৃথিবীতে এলাম না।

নুহাশপল্লীতেই আরেকবার হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এক আড্ডায় বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এমন এক যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি যে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতে হতো। বিশাল তার জ্ঞানের পরিধি। এটা সেটা নানা বিষয়ে কথাবার্তার পর উঠলো ধর্মবিষয়ক কথাবার্তা। একপর্যায়ে স্যারের কাছে আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা স্যার, ভালো কাজ করে বেহেশতে গেলে তো পুরুষরা ৭০ জন হুর পাবে। নারীদের ক্ষেত্রে কী হবে?

হুমায়ূন স্যার প্রথমেই কোরআন শরীফের একটা আয়াত পড়লেন। অবাক হলাম, কোরআনের আয়াত তার মুখস্ত দেখে। তারপর তিনি ব্যাখ্যায় এলেন।

স্যার বললেন, পুনরুত্থানের পর তোমার স্বত্বা কী হবে, তা কী তুমি বলতে পারো? বেহেশতে যাওয়ার পর নারী বা পুরুষ স্বত্বা তুমি নাও পেতে পারো। ফেরেশতারা না নারী, না পুরুষ? তারা যেমন কোনো লিঙ্গের নয়। তোমার পরিণতিও তো তাই হতে পারে। আর হুররাও যে নারী বা পুরুষ হবে, তা নিশ্চিত হও কী করে।

শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার মধ্যে তখন তীব্র সংঘাত। দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য তৈরির জন্য নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সে সময় হুমায়ূন স্যারের এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনাকে যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বলা হয় তাহলে কী করবেন?

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমি দুই নেত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে বলব, আপনারা এক ঘণ্টার জন্য আমাকে সময় দেন। আমার নুহাশ পল্লীতে আপনারা একবার এসে এককাপ চা খান। তারপর জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখেন। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। আমি নিশ্চিত এই অল্পসময়েই দুই নেত্রীর মধ্যে ভাব হয়ে যাবে। কারণ, তারা দুজনেই খুব ভালো মানুষ। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের দুই পরিবারেরই অবদান আছে। দুজনই দেশকে ভালোবাসেন। কিছু সময়ের জন্য তারা একসঙ্গে হলেই তাদের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যাবে। দুজন মিলে তখন দেশ গড়ার উদ্যোগ নেবে। তখন আর আমাদের দেশকে ঠেকায় কে। দেখবে ধেই ধেই করে বাংলাদেশ কোথায় চলে যাবে।

অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ হুমায়ূন আহমেদ শুয়ে আছেন নুহাশ পল্লীতে লিচু গাছের নিচে মাটির বিছানায়। কিন্তু তার সংস্পর্শ পাওয়ার মুহূর্তগুলো এখনও ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভাসে।

লেখক : উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক, আরটিভি

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • বিনোদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
হুমায়ূন আহমেদকে পাগল উল্লেখ করে যা বললেন ছেলে নিষাদ
হুমায়ূন আহমেদ নির্লোভ মানুষ ছিলেন: ডা. এজাজ
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট ফারুকের
কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ