‘পাঠান’ বাংলাদেশে ভালো ব্যবসা করেছে। হয়তো ছবিটি আরো বেশি ব্যবসা করত যদি ভারতের সঙ্গে একই দিনে এদেশে মুক্তি পেত। কিন্তু ‘পাঠান’ মাল্টিপ্লেক্সে প্রত্যাশিত দর্শক টানলেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সিঙ্গেল স্ক্রিনে।
অথচ বলা হয়েছিল, হিন্দি ছবি দেশে এলে বেঁচে যাবে ধুঁকতে থাকা সিনেমা হলগুলো। এমনও স্লোগান গত কয়েক বছর ধরে শুনেছি- 'হল বাঁচলে সিনেমা বাঁচবে'। ‘পাঠান’ এর ব্যর্থতার পর এ কথা এখন বলাই যায়- সিনেমা হলগুলোর মৃত্যু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সিনেমা হল বলতে বোঝাচ্ছি সিঙ্গেল স্ক্রিন। আরো পরিষ্কার করে বললে গুদামঘরমার্কা সিনেমা হল। এই হলগুলো ঈদ এলে খোলে, ঈদ চলে গেলে বন্ধ হয়ে যায়। এই তামাশা চলছে গত তিন-চার বছর ধরে। এই সিনেমা হলগুলোর দোহাই দিয়েই হিন্দি ছবি আমদানি হলো। অথচ এই হলগুলো ‘পাঠান’ চালিয়ে লোকসানের শিকার।
শাহরুখ খানের ছবি চালিয়ে লাভ হলো তাদের, যারা আগে থেকেই লাভের খাতায় ছিলেন, অর্থাৎ মাল্টিপ্লেক্সগুলো। ‘হল বাঁচলে সিনেমা বাঁচবে’ না বলে যদি বলা হত 'হল বানালে সিনেমা বাঁচবে', তবে সেটাই হত সার্থক স্লোগান। কারণ, বিদ্যমান সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোকে বাঁচানোর সাধ্য দীপিকা পাড়ুকোনদের নেই।
যতই স্লোগান দেয়া হোক, হিন্দি ছবি আমদানি হয়েছে মূলত মাল্টিপ্লেক্সের মুনাফার জন্যই। সালমান খানরা এলেই নতুন-নতুন মাল্টিপ্লেক্স হবে। সরকারের ১ হাজার কোটি টাকার যে তহবিল, এতে এখনও কেউ হাত দেয়নি। হিন্দি ছবি লাগাতার মুক্তি পেলেই দেখা যাবে তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে মাল্টিপ্লেক্স তৈরির হিড়িক পড়েছে।
স্বাধীনতার পর, উর্দু ছবির নির্মাণ বন্ধ হলে প্রতিযোগিতাহীন বাজারে বাংলা ছবির জোয়ার এসেছিল। লেগেছিল সিনেমা হল নির্মাণের মহোৎসব। হিন্দি ছবি চালানোর জন্যও আগামীতে তেমনই উদ্দীপনা দেখে দেবে প্রদর্শকদের মধ্যে। আর হিন্দি ছবি না এলেও মাল্টিপ্লেক্সের উত্থান অনিবার্য। গোটা দুনিয়াতেই সিঙ্গেল স্ক্রিন হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে ঝাঁকে-ঝাঁকে মাল্টিপ্লেক্স।
ভারতের কথাই ধরা যাক। কোভিড মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রদর্শনব্যবস্থাকে কোমা থেকে উঠিয়ে আনতে দরকার ছিল সুচিকিৎসা। এ কারণেই ভারতের মাল্টিপ্লেক্স চেইন আইনক্স ও পিভিআর একীভূত হয় করোনার পর। যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আইনক্স-পিভিআর ভারতের ২৪টি শহরে ৩০টি নতুন মাল্টিপ্লেক্স খুলেছে। এগুলোতে স্ক্রিন যুক্ত হয়েছে ১৬৮টি। আইনক্স-পিভিআর বলছে, প্রতি বছর ২০০টি নতুন স্ক্রিন যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
করোনার সময় যারা বলেছিলেন, সিনেমা হলের যুগ শেষ, পরবর্তী দিন ওটিটির- তারা আসলে সিনেমা হলের ম্যাজিক সম্পর্কে অজ্ঞ। গত কয়েক বছর ধরে মাল্টিপ্লেক্সের যে বিপুল বিকাশ হচ্ছে, সে বিষয়েও অন্ধকারে ছিলেন তারা। ফলে ওটিটির সম্ভাবনা নিয়ে তারা যতটা সরব ছিলেন, ততটাই উদাসিন ছিলেন মাল্টিপ্লেক্সের বিস্তার সম্পর্কে।
‘পাঠান’ যেমনই ব্যবসা করুক না কেন, আগামী দিনে হিন্দি ছবির আমদানি চালু থাক বা বন্ধ হোক, কোনো ঘটনাই মাল্টিপ্লেক্সের উন্নতিকে ঠেকাতে পারবে না। আর মাল্টিপ্লেক্সের উন্নয়ন মানেই গতানুগতিক সিঙ্গল স্ক্রিনের কফিনে পেরেক।
মাল্টিপ্লেক্সের জয়গীতি লেখার সঙ্গে-সঙ্গে সিঙ্গল স্ক্রিন কেন মরছে- এই প্রশ্নেরও সদুত্তর খোঁজা জরুরি।
নব্বই দশকে প্রায় ৩০টা সিনেমা হল ছিল রাজধানীতে। অধিকাংশ সিনেমা হলে এয়ার কন্ডিশনার ছিল। ইত্তেফাকে প্রকাশিত সিনেমার বিজ্ঞাপনে হলগুলোর নামের সঙ্গে ব্র্যাকেটে ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’ কথাটা লেখা থাকত। সেই সময় এসির নিচে বসে দর্শকরা ছবি দেখেছেন গুলিস্তান, স্টার, জোনাকী, আনন্দ, মুন, পূর্ণিমা, মেঘনা, যমুনা, গ্যারিসন, বিডিআর, শ্যামলী, অভিসার, মধুমিতা ও বলাকা সিনেমা হলে।
আমি ঢাকার সিনেমা হলে ছবি দেখা শুরু করি ২০০০ সালে। সেই সময় মধুমিতা ও বলাকা ছাড়া কোনো সিনেমা হলই নিয়মিত এসি চালাত না। হল কর্তৃপক্ষ তাদের মর্জি অনুযায়ী কখনো এসি চালাত, কখনো ফ্যান চালাত। এরপর একটার পর একটা সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক বছর পর দেখলাম, মধুমিতা ও বলাকা ছাড়া জীবিত হলগুলোর মধ্যে কোথাও আর এসির অস্তিত্বই নেই। গত এক যুগে এই দুই সিনেমা হল ছাড়া কোথাও এসির আরাম পাইনি।
এখন বলুন! মল্লিকা, জ্যোতি, মানসী, সাগরিকা, আগমন, বিউটি, শাহীন, পূরবী, শাবিস্তান, এশিয়া, পদ্মার বন্ধ হওয়া কি অনিবার্য ছিল না? বন্ধ হওয়ার সময় এগুলোর প্রত্যেকটা বহু বছর ধরে এসিবিহীন ছিল, কিংবা কখনোই এসি চালু করার উদ্যোগ নেয়নি।
ত্রিশ বছর আগে যদি ঢাকার দর্শকরা এসি থিয়েটারে ছবি দেখে থাকেন, ত্রিশ বছর পর কেন তারা ঢাকার হল মালিকদের কাছে একটা সিনেমা হলের ন্যূনতম যে সুবিধা-এসি-সেটা প্রত্যাশা করতে পারবেন না? তাই ধরেই নিন, ঢাকার মুমূর্ষ হলগুলো অর্থাৎ চিত্রামহল, আজাদ, আনন্দ অচিরেই বন্ধ হবে।
নদীর এপার ভাঙে, ওপার গড়ে। সনাতন লায়ন বন্ধ হয়ে মাল্টিপ্লেক্স হয়েছে ‘লায়ন সিনোমাস’। সনি সিনেমা হল ভেঙে তার জায়গায় হয়েছে সিনেপ্লেক্স। পুরনো শ্যামলী দম ছাড়লেও এসেছে আধুনিক শ্যামলী। গুলিস্তানে একটা মাল্টিপ্লেক্স হলো না বলে আমাদের আফসোস আছে, কিন্তু আমরা আশাবাদী, আগামীতে সিনেমা হল ভাঙলেও সেখানে তৈরি হবে মাল্টিপ্লেক্স। আর নতুন মাল্টিপ্লেক্স কিংবা আধুনিক সিঙ্গল স্ক্রিন তো আসছেই একের পর এক। তবে কি সিনেমার সুদিন আসন্ন নয়?
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, আরটিভি