ঢাকারোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১

সিনেমা সুপার‌হিট হওয়া মানেই ‘সুদিন’ নয়

মাহফুজুর রহমান

শনিবার, ০৮ জুলাই ২০২৩ , ০৫:৫৪ পিএম


loading/img

২০১৬ সালে যখন ‘শিকারী’  ও ‘বাদশা’ রিলিজ হয়, তখন ঢাকা শহরে বলাকা, অভিসার, পূর্ণিমা, পূরবী, এশিয়া, পুনম, রাজমণি, জোনাকী, রাজিয়া, পদ্মা, সুরমা ইত্যাদি সিনেমা হলগুলো ছিল। রাজিয়া ও সুরমা ছাড়া সবগুলোই ছিল বড় প্রেক্ষাগৃহ। ছবি সুপারহিট হলে এগুলোর একেকটি থেকে প্রযোজক সপ্তাহে আয় করতেন গড়ে ২ লাখ টাকা।

বিজ্ঞাপন

এবার ঢালিউড যখন ২০১৬ সালের মতোই জমজমাট ঈদ উপহার দিল, তখন ঢাকায় এক মধুমিতা ছাড়া বলার মতো কোনো সিনেমা হল বেঁচে নেই। চিত্রামহল থেকে এখনও গড়ে দুই লাখ টাকা আসে। বাকি হলগুলো, অর্থাৎ গীত, সংগীত, আজাদ, সৈনিক ক্লাব, আনন্দ, ছন্দ, বিজিবি সিনেমা হলের ব্যবসা ও পরিবেশ মফস্বলকেও হার মানায়।

গত ৭ বছরে ঢাকা শহরের সিঙ্গল স্ক্রিন কোমায় চলে গেছে। ১৫/১৬ সালে ছবি রিলিজের আগে প্রযোজকরা যে ২০ লাখ টাকা ঢাকা থেকে পাবেন বলে প্রত্যাশা করতেন, এখন সেই টাকার জন্য তারা চেয়ে থাকেন মাল্টিপ্লেক্সের দিকে। ঢাকার মতোই সারাদেশের জেলা শহরগুলোতে বড় হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকার পাশের টঙ্গিতে চম্পাকলি, আনারকলি বন্ধ হয়ে গেছে, ডেমরায় মতিমহল, রানিমহল বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো ঢাকার হলগুলো থেকে বেশি টাকা দিত। ছবি সুপারহিট হলে সপ্তাহে গড়ে ৩ লাখ টাকা আসত এসব হল থেকে।

বিজ্ঞাপন

সিঙ্গল স্ক্রিনের ভগ্নদশার কারণে প্রযোজকরা এখন ছবি সুপারহিট না হলে তেমন কোনো পয়সা পান না। এটা ঠিক, সুপারহিট হলে সিঙ্গল স্ক্রিন থেকেও কোটি টাকা চলে আসে, এই মুমূর্ষু অবস্থায়ও। কিন্তু আমাদের এখানে সুপারহিট ছবি আজকাল সোনার হরিণ। আর সুপারহিট ছবি দিয়ে একটি ইন্ডাস্ট্রির প্রকৃত স্বাস্থ্য বোঝাও যায় না।

একটি ইন্ডাস্ট্রির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে পারে তার গড়পরতা ছবিগুলো। এদেশে এখন গড় ছবির বাজেট ৭০-৮০ লাখ টাকা। বছরে ৩০-৪০টি ছবি মুক্তি পায়। দু চারটা ছবি ছাড়া সিংহভাগ ছবি পুঁজির অর্ধেকটাও সিনেমা হল থেকে তুলতে পারে না। কোনো ছবি ১০ লাখ, কোনো ছবি ৫ লাখ তুলেই দম ছেড়ে দেয়। এই অবস্থাটাই সিনেমাকে দিনকে দিন রুগণ করে তুলছে।

বিজ্ঞাপন

ঢালিউড হয়ে গেছে সুপারহিট ছবির ইন্ডাস্ট্রি। বছরে একটা বা দুটো ছবি অপ্রতাশিত ব্যবসা করে, তারপর সবাই বলতে শুরু করে- সিনেমার সুদিন এসে গেছে! একজন বা দুজন প্রযোজক ব্যবসায়িক সাফল্য পেলে তা সামগ্রিক ইন্ডাস্ট্রির সুস্বাস্থ্য প্রমাণ করে না। বরং একটা ফ্লপ ছবির প্রযোজক পুঁজির কতটা তুলে আনতে পারলেন, তার ওপরই নির্ভর করে ইন্ডাস্ট্রির সক্ষমতা । আর এখানেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ব্যর্থতা পুরোপুরি দৃশ্যমান।

অথচ নব্বই দশকে তো বটেই, এমনকি শূন্য দশকেও ফ্লপ ছবির প্রযোজকরা দ্বিতীয়/তৃতীয় ইনিংস খেলতে ভয় পেতেন না। কারণ, তখনও বাজার এতোটা সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠেনি যে, একজন প্রযোজককে গিলে খাবে। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকবেই, চলচ্চিত্র ব্যবসায়ও ছিল হিট/ফ্লপ। কিন্তু এখনকার মতো লোকসানের এমন রাক্ষুসে চেহারা ছিল না। প্রযোজকের টাকাফেরতের নিশ্চয়তা ছিল, তা সেটা হোক বছরে কী দু বছরে। কিন্তু এখন ছবি ফ্লপ হওয়া মানেই প্রযোজকের পুঁজি সাগরের অতলে হারিয়ে যাওয়া। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেই বলা যাবে সিনেমার সুদিন ফিরেছে। সেই হিসেবে সিনেমার সুদিন এখনও দূর কি বাত। 

বাংলাদশি সিনেমায় বড় ধাক্কাটি এসেছে করোনাকালে। এসময় দেশের ধুঁকতে থাকা সিনেমা হলগুলো শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে। করোনার পর প্রযোজকরা সিনেমা হল সংকটে পড়ে যান। নতুন ছবি রিলিজ করতে গিয়ে ২০টি সিনেমা হল জোটানোও কঠিন হয়ে যায় একজন নতুন প্রযোজকের পক্ষে। অথচ ডিজিটাল প্রদর্শন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর, ২০১৩ সাল থেকে নতুন ছবি আগের চেয়েও বেশি সিনেমা হল পেতে শুরু করেছিল। ১৫-২০ বছর আগে নতুন ছবি যেখানে ২৫-৩০টি সিনেমাহলে মুক্তি পেত, সেখানে ৭/৮ বছর আগেও ৭০-৮০ টি সিনেমা হল পেত নতুন ছবি।

সেই জায়গায় করোনার পর হল সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। শাকিব খান ছাড়া অন্য কোন তারকাই বেশি সিনেমা হল পান না। শুধু এই নায়কের ছবি ১০০ প্রেক্ষাগৃহ পায়, তাও সেটা ঈদে। সিনেমার বাজার চাঙ্গাই হয় ঈদে। এসময় বন্ধ থাকা অনেক সিনেমা হল চালু হয় বলে প্রেক্ষাগৃহ সংকট সাময়িকভাবে কেটে যায়। কিন্তু সারাবছর প্রায় অর্ধশত সিনেমা হল বন্ধ থাকে বলে প্রযোজকরা প্রেক্ষাগৃহ থেকে কোনোভাবেই টাকা তুলে আনতে পারেন না।

ঈদে সিনেমা হলগুলো যেমন খুলে যায়, তেমনই দশকদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। করোনার পর গত চার ঈদে রেকর্ডসংখ্যক দর্শক সিনেমা হলে এসেছেন। এবারের ঈদুল আজহায় প্রেক্ষাগৃহে রীতিমতো দর্শক-বিস্ফোরণ ঘটেছে। অথচ সারাবছর এই দর্শকদের সিনেমা হলে পাওয়া যায় না। প্রেক্ষাগৃহের অভাবে, দর্শকের অভাবে প্রযোজকরা বিনিয়োগকৃত অর্থ বাজার থকে উঠিয়ে আনতে পারছেন না। সিনেমার চাকাও তাই সচল হচ্ছে না। উৎসবে, পার্বণে দর্শকরা সদলবলে সিনেমা হলে এলেও নিয়মিত তাদেরকে সিনেমা হলে পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়মিত দর্শকশ্রেণীর অভাবে প্রযোজকরা ব্যর্থ হচ্ছেন সিনেমা হল থেকে ন্যূনতম বিনিয়োগ তুলে আনতে।

কোনো ছবি সুপারহিট না হলেও মোটামুটি একটা অর্থ যেন সিনেমা হল থেকে উঠে আসে, তার নিশ্চয়তা দেয়াটা খুব জরুরি এখন। এই সময়ের প্রযোজকদের মধ্যে খুব কমজনই লাভের আশায় সিনেমায় বিনিয়োগ করছেন, পুঁজি উঠিয়ে আনতে পারলেই তারা সন্তুষ্ট। আর সেই পুঁজির পুরোটাও সিনেমা হল থেকে আশা করেন না তারা; স্যাটেলাইট রাইটস, ওটিটি রাইটস, ডিজিটাল রাইটসসহ বিভিন্ন খাত থেকে প্রযোজকদের আয়ের সুযোগ আছে।

প্রযোজকরা চান সিনেমা হল থেকে ভালো রকমের একটা হিস্যা। কিন্তু সিনেমা হলগুলো তা দিতে পারছে না। অনেক প্রযোজক সিনেমা হলকে 'মাইনাস' ধরেই ছবি নির্মাণ করছেন। এই পরিস্থিতিকে আর যাই-ই হোক, সিনেমার সুদিন বলা যাবে না।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, আরটিভি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |