বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বরফ পুরোপুরি গলে যাক

সিরাজুল ইসলাম

মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫ , ০১:৪০ পিএম


বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বরফ পুরোপুরি গলে যাক
লেখক: সিরাজুল ইসলাম

বাংলাদেশ-ভারতের কূটনীতিক সম্পর্ক বহু বছর ধরেই উষ্ণ ছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং তিনি ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে সেই সম্পর্কে বরফ জমতে থাকে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য; বাংলাদেশের তরফে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি; দুই দেশের রাজনীতিকদের উস্কানিমূলক বক্তব্য; উপ-হাইকমিশনে হামলার মতো কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রতিবেশী দেশ দুটিকে অনেকটা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

বিজ্ঞাপন

যদিও উভয় দেশই পরিস্থিতি অত্যন্ত দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছে। নীতি-নির্ধারকরা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছে যে নিজেদের স্বার্থেই সম্পর্কটা ভালো রাখা দরকার। তবে ভারতের কিছু কর্মকাণ্ডে মনে হয়েছিল যে তারা বাংলাদেশকে ‘এড়িয়ে চলতে’ চায়। বিশেষ করে থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক আয়োজন নিয়ে বেশ তোড়জোড় ছিল ঢাকার; কিন্তু দিল্লির পক্ষ থেকে সাড়া মিলছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দুই সরকার প্রধান বৈঠকে মিলিত হন। এটাকে মাইলফলক হিসেবেই দেখতে হবে। তাৎক্ষণিক এই বৈঠকে তেমন লাভ না হলেও কূটনীতিতে অর্জন অনেক। প্রতিবেশী দুই দেশের অনেক সমস্যার সমাধানের সূত্রও এটি।


কী পেল বাংলাদেশ: থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে শেষ হলো দিনব্যাপী বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন) সম্মেলন। গত শুক্রবার এই সম্মেলন শেষ হয়। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু এই সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্জন কী, তা নিয়ে অনেকের কৌতুহল রয়েছে। এর মূলে রয়েছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। এই সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ড. ইউনূসের একটি বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা করে যাচ্ছিল ঢাকা। এ বিষয়ে একটি চিঠিও পাঠানো হয় দিল্লিকে; কিন্তু সাড়া মিলছিল না। ফলে এই দুই নেতার বৈঠকটি প্রায় অনিশ্চিত ছিল। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তারা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে প্রায় ৪০ মিনিট আলোচনা করেন। সীমান্ত হত্যা, আন্তঃনদীর পানি বন্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে বৈঠকে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। আলোচনায় স্থান পায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্যুও।

বিজ্ঞাপন

যে কারণে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে দেশটি। এছাড়া একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং আরেক দিকে মিয়ানমার। সুতরাং ভৌগলিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের সাতটি রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) স্থিতিশীলতাও বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। কারণ বাংলাদেশ উত্তপ্ত হলে এর আঁচ লাগে এই সেভেন সিস্টার্সে। দেশ দুটির মধ্যে রয়েছে বিশাল বাণিজ্য। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। এই যুদ্ধে তাদের ১ হাজার ৬৬১ হাজার সেনা প্রাণ হারায়। এসব কারণে দেশ দুটির মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজমান। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। আবার ভারতেরও কিছু নেতা বাংলাদেশ বিদ্বেষী বয়ান দেন। এছাড়া কলকাতা, ত্রিপুরা ও মহারাষ্ট্রে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলা চালায় ভারতের উগ্রপন্থী কিছু লোক। বাংলাদেশের কিছু মানুষ পানি আগ্রাসন ইস্যুতে ভারতের হাইকমিশন ঘেরাও করতে যায়। উভয় দেশের অনেক নেতা একে অপরের পণ্য বর্জনের ডাক দেন। সব মিলিয়ে এক সময়ের উষ্ণ সম্পর্কে বরফ জমতে থাকে। এই সম্পর্কটাকেই এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল বাংলাদেশ।

সম্পর্কের বরফ গলছে: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্যাংককে দ্বিপক্ষীয় খোলামেলা বৈঠক করেছেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তারা খোলামনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাদের ৪০ মিনিটের আলোচনা ছিল খোলামেলা, ফলপ্রসূ ও গঠনমূলক। বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। আমাদের দুটি দেশের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় ইতিহাস, ভৌগোলিক নৈকট্য এবং সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের কঠিন সময়ে ভারত সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে সম্পর্ককে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে আমরা আপনার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চাই। বিমসটেকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস সাত সদস্যদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য ভারতের সমর্থন চান। তিনি গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের আলোচনা এবং তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করার আহ্বান জানান। ড. ইউনূসের বক্তব্যের ইতিবাচক জবাব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় অধ্যাপক ইউনূসকে অভিনন্দন জানান এবং ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানান তিনি। নরেন্দ্র মোদী বলেন, ভারত সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। দুই প্রতিবেশী দেশের ইতিহাস বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় থেকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক মর্যাদার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ভারত সর্বদা একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারত বাংলাদেশে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক খারাপ হয়Ñ এমন বক্তব্য পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আশা করেনÑ ভবিষ্যতে ভারত এমন এক গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে নির্বাচনের একটি ভূমিকা রয়েছে। নরেন্দ্র মোদীকে উদ্ধৃত করে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা উভয় দেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা বয়ে এনেছে। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের আকাক্সক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। পরিবেশকে খারাপ করে এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।


কারো দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া যাবে না: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিচার হয়নি। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশিরা পাকিস্তানিদের ভালো চোখে দেখে না। ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের কূটনীতিক সম্পর্ক থাকলেও তা তেমন উষ্ণ নয়। শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে এই সম্পর্ক ছিল নামমাত্র। কিন্তু ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এটাকে ভারত ভালোভাবে নেয়নি বলেই মনে হয়। কারণ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার কারণে ভারতকে পাকিস্তান শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করে। ভারতও তা-ই মনে করে। অন্যদিকে ভারতের আরেক প্রতিবেশী চীনও তাদের শত্রু রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত। অন্যদিকে চীন ও পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও ভালো। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফর করেছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নাখোশ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। কোনও রাষ্ট্রের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া বাংলাদেশের জন্য ঠিক হবে না।

বিজ্ঞাপন


দায়িত্বশীল আচরণ দরকার: মোদী-ইউনূস বৈঠক আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। এই বৈঠকের মধ্যদিয়ে দেশটির সম্পর্কের বরফ গলে যাবে বলে তিনি আশা করেছেন। তবে এই সম্পর্ককে টেকসই করতে দুই দেশেরই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কোনওভাবেই উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া যাবে না। উভয়দেশের সংবাদমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। গুজব, অপপ্রচার, বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে না। শিরোনাম করার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একেবারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি না হলে তার বক্তব্য প্রচার না করাই ভালো। মনে রাখতে হবেÑ ঝগড়া, সহিংসতায় কেবল ক্ষতিই হয়, লাভ হয় না। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকা দরকার।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সাংবাদিক/ বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ

ডিসিএনই

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission