৫০ দিনে কার পার্কিংকে ৫০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড বানালো সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল
মাত্র ৫০ দিনে একটি কার পার্কিংকে ৫০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ডে পরিণত করেছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল (এসজিএইচ)। সেখানকার নার্স ক্লিনিসিয়ান থুরগাতাভি পি ভেল্লাস্বামী বলেন, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ভেতর দেখতে কেমন। হাসপাতালের নতুন এই আইসোলেশন ওয়ার্ডের ভেতরটা কেমন হবে, তা নিয়ে থুরগাতাভিরও আগ্রহ কম ছিল না।
মে মাসের মাঝামাঝি যেখানে খোলা আকাশের নিচে একটি কার পার্কিং ছিল, সেটিই মাত্র ৫০ দিনে পুরোপুরি একটি ওয়ার্ডে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে ৫০ জন সন্দেহভাজন এবং আক্রান্ত করোনাভাইরাস রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।
গত ১৫ জুলাই এটা চালু করা হয়। ফলে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের সক্ষমতা দ্বিগুণ হয়। এর আগে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৫১টি বেড ছিল। এর মধ্যে ৩৫টি সিঙ্গেল রুম ও ১৬টি শেয়ারড রুম বেড ছিল।
দরজা খুলে নতুন আইসোলেশন ওয়ার্ডে ঢুকলেই প্রশস্ত রিসেপশন স্পেসের পর ৫০টি পারপাস-বিল্ট কন্টেইনার রুম রয়েছে। প্রতিটি রুমে একটি সিঙ্গেল বেড, বাথরুম, ডেস্ক, চেয়ারের পাশাপাশি নেগেটিভি প্রেসার রয়েছে। যাতে কেউ ঢুকলে বা বের হলে বাতাসে যেন বের না হতে পারে।
হাসপাতালের বোয়ার ব্লকের কাছাকাছি হওয়ায় এই আইসোলেশন ওয়ার্ডের নাম দেয়া হয়েছে ওয়ার্ডঅ্যাটবোয়ার। এখানে যেকোনো হাসপাতালের ওয়ার্ডের মতো নার্স স্টেশন, বিশ্রামের জায়গা এবং কর্মীদের জন্য চেঞ্জিং রুম এবং ডাক্তারদের জন্য অন-কল রুম রয়েছে।
ওয়ার্ডটির দায়িত্বে থাকা নার্স ক্লিনিসিয়ান থুরগাতাভি বলেন, এটা খুব সুন্দরভাবে তৈরি করা হয়েছে।
বেল বাজানোর ঝামেলা নেই
স্বাভাবিক হাসপাতালের ওয়ার্ডের চেয়ে এই ওয়ার্ডে কিছুটা ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন প্রত্যেক রোগীকে তাদের হাতে পড়ার জন্য একটি বায়োসেন্সর দেয়া হয়েছে। এই সেন্সর তারবিহীনভাবে রোগীর হার্ট রেট, রেসপিরেশন রেট এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন একটি মোবাইল অ্যাপে পৌঁছে দেয়, যার মাধ্যমে রোগীর খবর জানতে পারেন কর্মীরা।
ইন-রুম স্মার্টফোনের মাধ্যমে রোগীরাও এই ডাটা অ্যাকসেস করতে পারে। এছাড়া এই ডিভাইসের মাধ্যমে তারা ভিডিও কনফারেন্স বা মাইকেয়ার লাইট অ্যাপের সাহায্যে তাদের কেয়ার টিমকে কল দিতে পারেন রোগীরা। এর ফলে অতিরিক্ত কোনও যন্ত্রপাতি না ব্যবহার করেই রোগী অবস্থা পর্যালোচনা করতে পারে ডাক্তার বা নার্সরা।
অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স ক্লিনিসিয়ান অ্যাসথার ফ্যান বলেন, এর মাধ্যমে রোগীদের দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নার্সদের সময় কম লাগছে। তিনি বলেন, এতে করে প্রতি ট্রিপে ১০ মিনিট করে বাঁচতে পারে। ফ্যান বলেন, এর আগে রোগীরা কল বেল চাপতেন এবং নার্সরা রোগীদের রুমে যেতেন, কি লাগবে তা জানতে চাইতেন তারা এবং প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে আবার রুম থেকে বের হতেন। তিনি বলেন, এখন ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সময়ের পরিমাণও কমে যাচ্ছে কর্মীদের।
এই আইসোলেশন ওয়ার্ডে একটি এক্স-রে ইউনিটও রয়েছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক রেডিওলোজী বিভাগের নকশায় এই এক্স-রে ইউনিটে রোগী ও রেডিওগ্রাফের জন্য আলাদা বুথ রয়েছে। সেক্ষেত্রে একজন রেডিওগ্রাফের পুরো পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পরার বদলে শুধু একটি এন৯৫ মাস্ক পরলেই হচ্ছে।
এসজিএইচ’র মেডিকেল বোর্ডের চেয়ারম্যান, সহযোগী অধ্যাপক রুবান পুপালালিংগাম বলেন, এই ওয়ার্ডের নকশা এবং বৈশিষ্ট্য এমন যা স্থিতিশীল, চলাফেরা করতে এবং নিজেদের যত্ন নিজেরাই নিতে পারে এমন রোগীদের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা।
এটা চাঙ্গি এক্সিবিশন সেন্টারের মতো কমিউনিটি কেয়ার ফ্যাসিলিটির চেয়ে ভিন্ন। কারণ ওই ফ্যাসিলিটি ‘হাসপাতালে থাকার দরকার নেই’ এমন ব্যক্তিদের জন্য।
সহযোগী অধ্যাপক রুবান পুপালালিংগাম বলেন, কিন্তু এসজিএইচ’র এই ওয়ার্ড ভিন্ন। এখানে যেই রোগীরা আছেন, তারা হাসপাতালে ভর্তি করার মতো, কিন্তু তাদের যথাযথ যত্নসহ আলাদা আইসোলেশন ফ্যাসিলিটি দরকার। ৩২০০ বর্গমিটারের এই ওয়ার্ডটি বিদেশি কর্মীদের জন্য স্থাপিত মেডিকেল পোস্টের চেয়ে আলাদা। পুপালালিংগাম এটাকে ‘একটি এইচডিবি ব্লকের নিচে একটি জিপি ক্লিনিক হিসেবে তুলনা করেছেন।’
তিনি বলেন, যদি কেউ অসুস্থবোধ করেন, তাহলে তারা নিচে নেমে ডাক্তার দেখাতে পারেন। সেখানকার দলটি তখন সিদ্ধান্ত নেবে যে তাদের কি করা উচিত, তাদের অর্থাৎ কর্মীদের কি হাসপাতালে পাঠানো উচিত নাকি তাদেরকে সাধারণ ওষুধ দিয়ে ডরমিটরিতে ফেরত পাঠানো উচিত?
কীভাবে শুরু হলো
তারা একটি প্রকল্প নিতে আগ্রহী কিনা জানতে চেয়ে সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসজিএইচ’র চিফ অপারেটিং অফিসার তান জ্যাক থিয়ানকে এপ্রিলের মাঝামাঝি এক রোববার একটি ইমেইল পাঠান। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে এসজিএইচ’র দুইদিন লাগে।
তিনি বলেন, অবশ্যই আমি আমার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছি, আমরা কি করতে সক্ষম? যখন তারা বললো যে, আমরা এটি করতে পারি, তাদের প্রতি আমার পুরো আস্থা ছিল। থিয়ান বলেন, সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোমের (সার্স) সময় এসজিএইচ’র এ ধরনের ‘কন্টেইনার সিটি’ তৈরির অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ওই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত আমাদের প্রচুর কর্মচারীর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। তবে নতুন ওয়ার্ডটিতে কন্টেইনার সিটির বেশ কয়েকটি ‘ডিজাইন ধারণা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
থিয়ান ও তার টিম যত দ্রুত সম্ভব এই প্রজেক্ট শেষ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু এটি করায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তাই নির্ধারিত ৪০ দিনের বদলে নির্মাণকাজ শেষ হতে ৫০ দিন লেগে যায়।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জনশক্তির স্বল্পতা। কেননা ‘সার্কিট ব্রেকার’র সময় এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং বিদেশি কর্মীরা ডরমিটরি থেকে বের হতে পারেনি। থিয়ান বলেন, আমরা বেশ ভাগ্যবান যে আমাদের ঠিকাদাররা সিঙ্গাপুরিয়ান এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের সহায়তা নিতে পেরেছিলেন। তবে প্রকল্পের শেষ দুই সপ্তাহের দিকেই আমরা কিছু বিদেশি কর্মী পেয়েছি।
তিনি আরও জানান, সাপ্লাই চেইন ইস্যুর কারণে ঠিকাদারদের নির্মাণ সামগ্রী পেতেও সমস্যা হয়েছিল এবং কোনও কোনও দিন বজ্রপাতের কারণে কাজ স্থগিত করতে বাধ্য হতে হয়েছে, যা বিলম্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
সৃজনশীল সমাধানের খোঁজে
নির্মাণকাজ চলাকালীন অন্যান্য দলগুলো হাসপাতালের সব কর্মীদের সঙ্গে পরিকল্পনা ও বৈঠক করে। তারা নতুন ওয়ার্ডের প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।
থুরগাতাভি বলেন, আমরা সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে প্রচুর বৈঠক করেছি। যদিও আমি এখানে ২২ বছর ধরে কাজ করছি, কিন্তু আমি অনেককে চিনতাম না। এখন আমি অনেক লোককে, বিশেষত ফ্যাসিলিটিস বিভাগের লোকেরা চিনতে পেরেছি।
তিনি বলেন, অনকোলজির মতো বিভিন্ন বিভাগের কর্মীদের এই ওয়ার্ডে আনা হয়েছে। তার ভাষায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অনুশীলনগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য একে অপরকে চেনা অগ্রাধিকার বিষয়। তিনি বলেন, এটা শুরু হওয়ার আগে সবাই যেন সুপ্রশিক্ষিত হতে পারে তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম আমরা। আর এজন্য ওয়ার্ডে নিযুক্ত সব কর্মীদের সপ্তাহব্যাপী ইনডাকশন প্রোগ্রাম শেষ করতে হয়।
থুরগাতাভি বলেন, তিনি কলোরেক্টাল সার্জারি ওয়ার্ডে কাজ করেন। সাধারণ ওয়ার্ডের রোগীদের নার্সিংয়ের চেয়ে আইসোলেশনের রোগীদের নার্সিং খুব আলাদা। আপনাকে পুরোপুরি পিপিই পরে থাকতে হবে এবং আইসোলেশন প্রক্রিয়ার অনেক কিছু নখদর্পণে থাকতে হবে।
তিনি বলেন, এই ওয়ার্ডে কাজের সময় কোড ব্লু’র মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সাধারণ ওয়ার্ডে কর্মীরা রোগীদের চেতন ফিরলে এবং ইনটিউবেট হলে অনুযায়ী নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে প্রেরণ করতে পারেন। তবে নতুন ওয়ার্ডের রুমগুলো ছোট এবং সংকীর্ণ, সুতরাং এখানে স্কুপ স্ট্রেচার ব্যবহার করতে হচ্ছে।
থুরগাতাভি জানান, অ্যাম্বুলেন্সগুলো এটি ব্যবহার করে, কিন্তু আমরা কখনই এগুলো ব্যবহার করিনি, কারণ আমাদের পুরো বিছানা ঠেলা দরকার। রোগীদের আমাদের স্ট্রেচারে স্কুপ করা দরকার, রোগীকে ঘর থেকে বের করে এনে তাকে একটি দীর্ঘ ট্রলিতে বসাতে হয়, তারপর তার চেতন ফেরানোর জন্য অন্য আরেক জায়গা ঠেলে নিতে হয়।
তিনি বলেন, প্রক্রিয়াগুলো অনুকরণ করতে এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। নার্সরা বহুবার প্রশিক্ষণ নিয়েছিল এবং আমরা অনেকবার ড্রিল করেছি।
তিনি জোরই বলেন, রোগীদের সেবাযত্নে যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, তা নিশ্চিত করতে এই কর্মযজ্ঞ। তিনি বলেন, এসজিএইচ’র মূল ব্লকে রোগীরা যেভাবে সেবা পান, এখানেও তাই পাবেন। প্রক্রিয়া, প্রোটোকল এবং নির্দেশিকা সবই এক।
যতদিন সম্ভব এই ওয়ার্ড ব্যবহার করা হবে
এই ওয়ার্ডটি স্থায়ী নাও হতে পারে উল্লেখ করে সহযোগী অধ্যাপক পুপালালিংগাম বলেন, করোনা রোগীর চাপ কমে গেলেও আশা করি এটা কাজে আসবে। আসলে ‘এটি কয়েক বছর’ টেকা মতো করে তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এটা করোনা মহামারির সময় ব্যবহৃত হবে কিন্তু পরে অন্যান্য সংক্রামক রোগের সময়ও কাজে আসবে। এজন্য যক্ষ্মা এবং হুপিং কাশির মতো সংক্রামক রোগের রোগীদের চিকিৎসা এখানে করা সম্ভব। যতদিন ব্যবহার করা যায়, আমরা ততদিন এটার ব্যবহার করবো।
এদিকে ওয়ার্ডটিতে রোগীদের আসা শুরু হলো তখন থিয়ানের রোববারের সেই ইমেইলের কথা মনে পড়ে যায় এবং তার টিমের ওপর ভরসার ফলই হচ্ছে এই প্রজেক্ট। গত কয়েক মাস সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলেছে। তবে যখন প্রথম কন্টেইনার ইউনিট ওয়ার্ড প্লাটফর্মে বসানো হয় তখন সেটাই ছিল থিয়ানের কাছে সন্তোষজনক মুহূর্ত।
তিনি বলেন, আমরা প্রথম বাধা অতিক্রম করেছি। এরপর এই প্রকল্প শেষ হওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।
সেই উত্তেজনাকর মুহূর্তের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ওয়ার্ড সম্পন্ন হওয়ার পর যখন প্রথমবার সেখানে প্রবেশ করি, ততক্ষণে কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। থিয়ান বলেন, আমি পুরো প্রজেক্ট নিয়ে দারুণ অনুভব করছি। আমাদের টিমগুলো এক হয়েছে এবং এসজিএইচ’র টিমওয়ার্ক দেখার সুযোগ মিলেছে। এটা দারুণ অনুভূতি।
এ/ এমকে
মন্তব্য করুন