আকর্ষণীয় লোকজ নকশা আর উজ্জ্বল রঙের কারণে সার্বিয়ার কোভাচিৎসার ‘নাইভ পেইন্টিং’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ইউনেস্কোর মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় যুক্ত হয়েছে এর নাম।
ভিরোস্লাভা সোয়েতলিক উত্তর সার্বিয়ার ভয়ভদিনা অঞ্চলের ছোট শহর কোভাচিৎসার একজন চিত্রশিল্পী। শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দার মতো তিনিও সার্বিয়ার স্লোভাক সংখ্যালঘুদের একজন। সার্ব এবং হাঙ্গেরিয়ানদের পর সার্বিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হলো স্লোভাক। কোভাচিৎসা সার্বিয়ায় নাইভ পেইন্টিং এর জন্মভূমি হিসাবে পরিচিত। এটি এমন এক শিল্প রূপ, যা লোকজ মোটিফ প্রদর্শন করে এবং কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিল্পীরা এগুলো তেলরঙ দিয়ে আঁকেন।
সোয়েতলিক বলেন, আমি বলবো যে, এটি আত্মা থেকে উদ্ভূত বিশুদ্ধ চিত্রকর্ম। আমি একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে যা অনুভব করি, যা দেখি এবং যা ভালোবাসি, তাই আঁকি। সরল চিত্রকর্ম একটি মহান ভালোবাসা। বেশিরভাগ চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে আসে, যদিও প্রত্যেক শিল্পী তার শিল্পকর্মকে একটি ব্যক্তিগত, মৌলিক স্পর্শ দেন। সোয়েতলিকের চিত্রকর্মে শিশু আর ফুলের উপস্থিতি দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। তবে ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ নাইভ পেইন্টার পাভেল হায়কোর কাজে রঙিন মোরগ একটি প্রভাবশালী মোটিফ।
পাভেল হায়কো বলেন, আমি একটা কিছু প্রায় পাঁচ বছর ধরে আঁকি, তারপর নতুন কিছু খুঁজে পাই। সবসময় নতুন কিছু যোগ করি। শুরুতে শেয়াল আর মোরগ ছিল, তারপর কিছু কামোত্তেজক ছবি আঁকা শুরু করি। এখন কাপড় পড়া থাকে, এমন নতুন কিছুর চেষ্টা করছি। আমি পরিবর্তন করতে পছন্দ করি এবং সবসময় একই জিনিস করি না।
ইউনেস্কো গত ডিসেম্বরে কোভাচিৎসার নাইভ পেইন্টিংকে মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় যুক্ত করেছে। এই আবেদনে সমর্থন করা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন চিত্রশিল্পী পাভেল বাবকা, যিনি তার স্ত্রী ক্লারার সাথে মিলে ৩০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী এই ধরণের শিল্প প্রদর্শন করে আসছেন।
বাবকা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পাভেল বাবকা বলেন, এটা স্লোভাক আর্টের প্রথম শাখা, যা ইউনেস্কোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া আমাদের দেশে আমাদের শিল্পকর্মই সংখ্যালঘু সংস্কৃতির একমাত্র উপাদান, যা ইউনেস্কোর অস্পষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে। এটা একটা বড় অর্জন।
নাইভ পেইন্টার ক্লারা বাবকা বলেন, এসব চিত্রকর্মের রঙ সবসময় উজ্জ্বল থাকে। যারা গ্যালারিতে এসে প্রথমবার এসব শিল্পকর্ম দেখেন, তারা সবাই চিত্রকর্মগুলি দেখে বলেন যে, এগুলি সত্যিই অপ্টিমিস্টিক- ডার্ক নয়, বিষণ্ণ নয়। আমার মনে হয়, এ কারণেই জনসাধারণ এই ধরণের শিল্পকর্মের এত প্রশংসা করে। কোভাচিৎসার সবচেয়ে বিখ্যাত নাইভ পেইন্টার ছিলেন সুজানা হালুপোভা, যিনি ২০০১ সালে মারা যান। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তার জন্মের শততমবার্ষিকী ছিল। হালুপোভা বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন, যার মধ্যে একটি নিউইয়র্কে ইউনিসেফের সদর দপ্তরের জন্য ছিল। এই ধারার আরেক শিল্পী ইভা হরকোভাকেও কিছু কাজ শিখিয়েছিলেন হালুপোভা।
নাইভ পেইন্টার ইভা হরকোভা বলেন, তিনি আমাকে কিছু সহজ মৌলিক রঙ শিখিয়েছিলেন- কীভাবে চরিত্র তৈরি করতে হয়, কীভাবে ক্যানভাসে জীবন তৈরি করতে হয়- সেই জীবন, যা একসময় এই অঞ্চলের মানুষ যাপন করেছিলেন। ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হওয়ার প্রধান শর্তগুলির মধ্যে একটি হলো, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে হবে। এ কারণে পাভেল বাবকা তরুণ শিল্পীদের এই ধরণের চিত্রকলা শেখান।
নাইভ পেইন্টার মারিনা পেট্রিক বলেন, আমরা গর্ব করতে পারি যে, ছোট্ট কোভাচিৎসা এখন সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাই অগাধ ভালোবাসা দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে এই ছবি আঁকা শেখানো আমার মহান দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। আমি বলতে পারি যে, কাজটা আমি ইতিমধ্যেই শুরু করেছি। ইউনেস্কোর মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় এই শিল্পরূপের সংযোজন প্রমাণ করে যে, কোভাচিৎসার নাইভ পেইন্টিংগুলি এখনও জীবন্ত। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে, যেখানে সারা বিশ্ব কোভাচিৎসার জীবনের এই প্রাণবন্ত, রঙিন চিত্রকর্মগুলি আবিষ্কার করবে।
আরটিভি/এএইচ