একই দিনে পুলিশের জালে শ্বেতা ও আরিয়ান খান। পর্নো ভিডিও ও যৌন ব্যবসা চালানোর অভিযোগ এই মা ও ছেলের বিরুদ্ধে। সোদপুরের এক তরুণীকে হাওড়ার ফ্ল্যাটে আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল এই দুজনের বিরুদ্ধে। তারপরেই সামনে আসে তাদের নানা কীর্তি। পুলিশের চোখে পাঁচদিন ধুলো দেয়ার পর দুই অভিযুক্তকেই পাকড়াও করা হয়েছে। ধৃত শ্বেতা ও আরিয়ান তরুণী উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই তার বয়ানের ভিত্তিতে শ্বেতা ও আরিয়ানকে খুঁজছিল পুলিশ। তাদের নানা অপকর্মের কথা উঠে আসছিল প্রতিদিন।
বুধবার সকালে আরিয়ান খানকে দক্ষিণ কলকাতার গলফগ্রিনে এক বন্ধুর ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২১ বছর বয়সি ছেলেকে জেরা করে মায়ের খোঁজে তল্লাশি জোরদার করা হয়। গা ঢাকা দেয়ার জন্য বারে বারে জায়গা বদল করছিলেন ৪৩ বছর বয়সি শ্বেতা ওরফে ফুলটুসি। বুধবার রাতে আলিপুরে তার খোঁজ পায় পুলিশ। শ্বেতা নিজের ফোন ব্যবহার করছিলেন না আত্মগোপন করার স্বার্থে। কিন্তু ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন অন্যান্য নম্বরের সাহায্যে। সেই নম্বর ট্র্যাক করে শ্বেতা খানকে আলিপুর থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার সূত্রে এক নাবালিকাকে বুধবার উদ্ধার করে পুলিশ। এই নাবালিকার কথা আগে জানা যায়নি।
আরিয়ানকে হাওড়া আদালত নয় দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে। নাবালিকাকে পাঠানো হয়েছে লিলুয়া হোমে। রাতে শ্বেতাকে রাখা হয় হাওড়া মহিলা থানার লকআপে। শ্বেতা ও আরিয়ানের পর্নো ও যৌন ব্যবসা এত দিন রমরমিয়ে চলেছে। পুরো বিষয়টি আড়ালে থেকে গিয়েছিল যত দিন না সোদপুরের তরুণী এই রহস্য ফাঁস করেছেন। তিনি দীর্ঘ ছয় মাস শ্বেতাদের হেফাজতে আটকে থাকার পরে কোনওরকমে ফ্ল্যাট থেকে পালিয়ে যান।
তরুণীর অভিযোগ, তাকে জোর করে পর্নো ভিডিওয় অভিনয় করাতে হাওড়ার ফ্ল্যাটে আটকে রাখা হয়েছিল। তিনি রাজি না হওয়ায় তার উপরে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালানো হয়। গত ৬ জুন এই অভিযোগ সামনে আসার পরে শুরু হয় হইচই। ফ্ল্যাটে তালা মেরে উধাও হয়ে যান মা ও ছেলে। সোদপুরের বাসিন্দা নির্যাতিতা তরুণী থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। সোদপুর থানা থেকে বিষয়টি পাঠানো হয়েছে হাওড়ার ডোমজুড় থানায়।
অভিযোগকারী তরুণী কামারহাটি সাগর দত্ত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এখনো তিনি বিপদ মুক্ত নন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পদক্ষেপ করেছে জাতীয় মহিলা কমিশন। মঙ্গলবারই রাজ্যপুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে একটি চিঠি পাঠানো হয় তাদের তরফে। চিঠিতে নির্যাতিতা তরুণীর প্রয়োজনীয় শারীরিক এবং মানসিক চিকিৎসা করাতে বলা হয়েছে এবং তিন দিনের মধ্যে অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। নানা কুকীর্তি মা-ছেলের এই তরুণী মুক্তি পাওয়ার পরে শ্বেতা ও আরিয়ানের একের পর এক কুকীর্তি সামনে আসতে থাকে।
এমনকী শ্বেতার সাবেক স্বামী সৈয়দ মোরসেলিম জানিয়েছেন, তার স্ত্রী কী ধরনের অপকর্মে যুক্ত ছিলেন। শ্বেতার এক নাবালিকা কন্যা আত্মঘাতী হয়েছিল। তাকে জোর করে যৌন ব্যবসায় নামাতে চেয়েছিলেন তার মা। এমনকী ছেলে আরিয়ানকে শ্বেতাই বিপথে নিয়ে গিয়েছেন বলে দাবি করেছেন মোরসেলিম। এই পরিস্থিতিতে সংসার ও ব্যবসার কাজ ছেড়ে এখন হুগলির ফুরফুরা শরিফে থাকেন তিনি।
পর্নো ব্যবসা চালানোর জন্য ফাঁদ পেতেছিলেন শ্বেতা ও আরিয়ান। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার পরিচয় সামনে রেখে যাবতীয় কুকর্ম চালাতেন এই দুজন। বিজ্ঞাপনে কাজ ও অভিনয়ে সুযোগ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কমবয়সি মহিলাদের আকৃষ্ট করা হত। এরপর তাদের পর্নো ব্যবসায় ব্যবহার করাই ছিল মা ও ছেলের উদ্দেশ্য। কেউ রুখে দাঁড়ালে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিতেন তারা। অবাধ্যতা করলে চালানো হত নির্যাতন, যার শিকার হয়েছিলেন সোদপুরের তরুণী। তাকে প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে আরিয়ান হাওড়ার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন বলে অভিযোগ। এই ফ্ল্যাটের একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামনে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই তরুণীকে মারধর করছে এক নাবালিকা। আরিয়ান সেই সময়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে মারধর করতে দেখা যায়নি। যদিও আরিয়ানের বিরুদ্ধে মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন তরুণী।
আরিয়ান পর্নো ভিডিও বানানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তিনি একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য কনটেন্ট তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিলেন। বরং ওই বিবাহিতা তরুণীর বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন অভিযোগ কারিণী। বিয়েরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু, আরিয়ান প্রস্তাবে রাজি হননি বলে দাবি করেছেন। বছরের পর বছর একটি ফ্ল্যাটকে কেন্দ্র করে এ ধরনের কাজকর্ম কীভাবে চালাতে পেরেছেন শ্বেতা ও আরিয়ান, এই প্রশ্ন উঠেছে।
একাধিক প্রতিবেশীও বলেছেন, তারা খান পরিবারের দৌরাত্ম্যে তটস্থ ছিলেন। অথচ ভারতের পর্নোগ্রাফি বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, তথ্যপ্রযুক্তি আইন, পকসো আইনে এই অপরাধের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার সংস্থান রয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ২৯৪ ও ২৯৫ নম্বর ধারায় অশ্লীল বা আপত্তিকর বিষয় প্রকাশে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার জেল ও জরিমানা হতে পারে। ২৯৫ নম্বর ধারাটির ক্ষেত্রে শুধু অপ্রাপ্তবয়স্কদের পর্নোগ্রাফির কথা বলা হয়েছে। পকসো আইনের ১৫ নম্বর ধারা অনুসারে নাবালকদের পর্নোগ্রাফি সংরক্ষিত রাখা অপরাধের মধ্যে পড়ে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এই পর্নো ফিল্ম নিজের কাছে রাখা ও সেগুলি দেখাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন স্থানীয় মানুষরা যখন দিনের পর দিন জানতেন যে কী ঘটছে শ্বেতা খানের ফ্ল্যাটে, সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, নির্দিষ্ট কেসের কথা বলতে পারব না, তবে সাধারণত এরকম অপরাধ যারা করে, তারা একটা বোঝাপড়া করে স্থানীয় স্তরে। তাই যারা ব্যবস্থা নিতে পারবেন, তারা এদের অপরাধের খবর জানলেও বাধ্য না হলে হস্তক্ষেপ করেন না।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, অসৎ মানুষ নিজের সুবিধার বিনিময়ে দায়িত্ব, কর্তব্য ভুলে যায়। এটা উপর থেকে নিচের স্তরে সমস্যা। কয়েকদিন আগে ওড়িশাতে একজন আইএস অফিসার ১০ লাখ টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন। উপরের তলার অফিসাররা এ রকম হলে নীচের তলায় কী বার্তা যাবে? সমাজকর্মী বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, পুলিশের সঙ্গে সমাজের নিবিড় যোগ থাকা কাম্য। পুলিশ, প্রশাসনের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকাটাই প্রাথমিক দায়িত্ব। তাহলে কি পুলিশের সঙ্গে সমাজের যোগ নেই? লোকাল পুলিশকেই তো সোশ্যাল রিপোর্ট দিতে হয়। এটা পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেজন্যই এতগুলো থানা ভাগ করা হয়েছে। না হলে তো জেলায় একটা থানা থাকলে হয়ে যেত।
এটাকে আরো বৃহত্তর পরিধিতে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। বলেন, পর্নোগ্রাফি আস্তে আস্তে সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। পাড়ায় পাড়ায় ম্যাসাজ পার্লারে ব্যবসা ছড়াচ্ছে। স্থানীয় মানুষ সে খবর দিলে পুলিশ হানা দেয়। কিছুদিন আগে নিউ আলিপুর, কেষ্টপুর, কসবার বেশ কিছু অঞ্চলে মধুচক্রর হদিশ পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। শুধু শহর নয়, শহরতলিতে নতুন নতুন ফ্ল্যাটে, ম্যাসাজ পার্লারে এসব গজিয়ে উঠছে। সুরক্ষার জন্য এক্ষেত্রে পুলিশের নজরদারি ও সতর্কতা থাকা খুবই জরুরি।
নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী ও রাজ্য মহিলা কমিশনের সাবেক চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, পুলিশ ইন্টেলিজেন্সির দুর্বলতা অথবা কোনো একটা জায়গা থেকে ব্যাপক প্রশ্রয় আছে এসব ঘটনার নেপথ্যে। সোর্স মারফত পুলিশ এই খবর নিয়ে তারপর গুরুত্ব সহকারে বিষয়টা দেখে। হাওড়ায় শ্বেতা খানের পাড়া-প্রতিবেশীর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা কেন এর প্রতিকারের উপায় পেলেন না।
তিনি বলেন, পর্নোগ্রাফির প্রতি এক অদ্ভুত ধরনের ঝোঁক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। সেজন্য সেক্স এডুকেশন অবশ্যই পাঠ্য তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত।
নারী আন্দোলনের কর্মী, অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বলেন, স্থানীয় মানুষরা বারবার অভিযোগ করেছেন যে, কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেই তাদের মিথ্যে মামলা দিয়ে ফাঁসানোর ভয় দেখানো হতো। প্রতিবেশীদের অভিযোগ অভিযুক্তের সাবেক স্বামী সমর্থন করেছেন। স্বীকার করেছেন যে তাদের কন্যাকে শ্বেতা পর্নোগ্রাফি ব্যবসায় আনতে চেয়েছিলেন বলেই সে আত্মহত্যা করেছে। এটা দেখে অভিযোগের গভীরতাটা বোঝা যায়। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি এরা কিসের জোরে দিতেন, সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে।
তিনি বলেন, ১৪ বছর ধরে উনি ভাড়া না দিয়ে বসবাস করেছেন, এটা দীর্ঘদিনের অভিযোগ। অথচ তাকে কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। সোদপুরের নির্যাতিত তরুণী সামনে না এলে, গণমাধ্যম এতটা সক্রিয় না হলে শ্বেতা খান ধরা পড়তেন কি? বার ডান্স, ক্যাবারে ডান্স, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে রিলস তৈরি এখন একটা বিকল্প পেশা হয়ে উঠছে মেয়েদের ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কোথায়?
শাশ্বতীর বক্তব্য, আজ যখন বার গজিয়ে উঠছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট মেয়েদের বিকল্প জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেক্ষেত্রে মেয়েদের সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হলে খুবই মুশকিল। স্কুল শিক্ষিকার তথাকথিত সম্মানজনক চাকরির পরিণতি আমরা দেখেছি। তাই মেয়েদের জীবিকা নিজেদেরই বেছে নিতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও পুলিশকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। মেয়েদের জীবিকার ব্যবস্থা যখন করা যাচ্ছে না, তখন মেয়েরা যাতে ফাঁদে না পড়ে সেটাও প্রশাসনেরই দেখা উচিত।
সুনন্দার বক্তব্য, হাওড়ার এই ঘটনা অনেকগুলি প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল। আগে একটা নির্দিষ্ট এলাকাতেই এই বিকল্প পেশা আবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন মফস্বল থেকে শহরতলি, সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেরই জীবন এখন এমন কঠিন হয়ে গিয়েছে যে, পরিশ্রম করলেও জীবিকা পাওয়া যাচ্ছে না। সব ব্যাপারটাই হতাশার জায়গায় চলে যাচ্ছে।
আরটিভি/এএইচ