টিম ফ্রিড; সর্পপ্রেমী ব্যক্তিক্রমী এক মার্কিনী। পেশায় ছিলেন একজন অটোমোবাইল মেনানিক। ঘটনাচক্রে হঠাৎ সাপ নিয়ে কাজ করাই হয়ে ওঠে তার নেশা। দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে এ কাজে জড়িয়ে থাকতে থাকতে দুঃসাহসিক এক পরীক্ষা চালান সাপের বিষ নিয়েও।
ইচ্ছাকৃতভাবে ২০০ বারেরও বেশি ভয়ংকর সব সাপের দংশনে নিজেকে নীল করেছেন তিনি। এছাড়া ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে সাপের বিষ প্রবেশ করিয়েছেন ৭০০ বারেরও বেশি।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চালানো এই পরীক্ষাই এখন অমূল্য করে তুলেছে ফ্রিডের রক্তকে। তার রক্ত থেকেই তৈরি হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিভেনম।
শনিবার (৩ মে) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুরুতে ফ্রিড নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে চেয়েছিলেন, যাতে সাপ ধরার সময় নিজেকে রক্ষা করতে পারেন তিনি। নিজের এইসব কীর্তিকলাপ ভিডিও করে ইউটিউবে রেকর্ড করে রাখতেন তিনি।
নিজের ওপর পরীক্ষা চালানোর জন্য টিম ফ্রিড বিষ সংগ্রহ করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক কিছু সাপ থেকে, যার মধ্যে রয়েছে একাধিক প্রজাতির মাম্বা, কোবরা, তাইপান ও ক্রেইট।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, টিম ফ্রিডের রক্তে এমন এক ধরনের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, যা মারাত্মক ধরনের বিষের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।
টিমের রক্তে পাওয়া অ্যান্টিবডি নিয়ে ইতোমধ্যে পরীক্ষা চালানো হয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর ওপর। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে, সাপের বিষের মারাত্মক ডোজ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম এই অ্যান্টিবডি।
সাপের বিষ কাটাতে বর্তমানে যে থেরাপিগুলো প্রচলিত আছে, তা মূলত নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির সাপের বিষ অনুযায়ী কাজ করে; অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিকে যে সাপ কামড়েছে, সেই প্রজাতির সাপের জন্য তৈরি অ্যান্টিভেনমই দিতে হয়।
কিন্তু, ১৮ বছরের সাধনায় ফ্রিডের রক্তে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তা সব ধরনের সাপের দংশনের বিরুদ্ধে একটি সার্বজনীন অ্যান্টিভেনম তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
দেড় যুগ ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরে সাপের বিষ নিচ্ছেন টিম ফ্রিড। তবে, এসব শুরুর আগে গোখরার ছোবলে দুবার কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফ্রিড বলেন, আমি মারা যেতে চাইনি, আমার একটি আঙুলও হারাতে চাইনি। কাজ করতে পারবো না এমন পরিস্থিতির শিকার হতে চাইনি আমি। আমার লক্ষ্য ছিল বিশ্বের অন্যান্য মানুষের জন্য ভালো থেরাপি তৈরি করা। এটা একসময় আমার জীবনযাত্রার অংশ হয়ে যায়। আমি নিজেকে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকি—তাদের জন্য, যারা আমার থেকে আট হাজার মাইল দূরে সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছে।
বর্তমানে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয় ঘোড়ার মতো প্রাণীদের শরীরে সাপের বিষের ছোট ছোট ডোজ ইনজেকশন দিয়ে প্রয়োগ করার মাধ্যমে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেই বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা সংগ্রহ করে থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিষ এবং অ্যান্টিভেনমকে একে অন্যের সাথে মিলিয়ে দিতে হয়, কারণ একেক প্রজাতির সাপের বিষ একেক রকম হয়ে থাকে।
আবার একই প্রজাতির সাপের মধ্যেও অঞ্চল ভেদে নানা বৈচিত্র্য থাকে, বিষে পার্থক্য থাকে—যেমন, ভারতের সাপ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনম শ্রীলঙ্কার সেই একই প্রজাতির সাপের বিরুদ্ধে কম কার্যকর।
এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের অ্যান্টিবডি খুঁজছেন যাকে বলা হয় ব্রডলি নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি, যা বিষের নির্দিষ্ট অংশ নয়, বরং সব ধরনের বিষে থাকা সাধারণ অংশগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করবে।
এমন এক যুগান্তকারী অনুসন্ধানের সময়ই সেন্টিভ্যাক্স নামের বায়োটেক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ড. জ্যাকব গ্লানভিল খোঁজ পান টিম ফ্রিডের।
তিনি বলেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে ভাবলাম, বিশ্বে যদি কারও শরীরে এমন ব্রডলি নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে থাকে, তবে সেটা টিমের শরীরেই তৈরি হয়েছে। তাই আমি যোগাযোগ করলাম। প্রথম ফোনেই বললাম, 'বিষয়টা অদ্ভুত শোনালেও, তোমার কিছু রক্ত পেলে খুব ভালো হতো।
ফ্রিডও রাজি হয়ে যান ড. জ্যাকব গ্লানভিলের প্রস্তাবে এবং গবেষণাটি নৈতিক অনুমোদন পায়। কারণ গবেষণায় তাকে আর বিষ দেওয়া হয়নি, কেবল রক্ত নেওয়া হয়েছে।
গবেষণাটি মূলত ইলাপিডস নামের বিষাক্ত প্রজাতির সাপের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। ইলাপিডস হলো বিষধর সাপের দুটি গোত্রের মধ্যে একটিতে অন্তর্ভুক্ত। যার মধ্যে রয়েছে কোরাল সাপ, মাম্বা, কোবরা বা গোখরা, তাইপান ও ক্রেইট।
ইলাপিডসরা মূলত তাদের বিষে নিউরোটক্সিন ব্যবহার করে, যা তাদের শিকারকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পেশি স্থবির করে ফেলে যা ওই প্রাণীর মৃত্যুর কারণও হয়।
গবেষকরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিহ্নিত সবচেয়ে মারাত্মক ১৯টি ইলাপিডস প্রজাতির ওপর পরীক্ষা করেন এবং এই বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে তারা ফ্রিডের রক্ত পরীক্ষা শুরু করেন।
বিজ্ঞান সাময়িকী 'সেল'-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, তারা দুটি ব্রডলি নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি শনাক্ত করেছে, যা দুটি আলাদা নিউরোটক্সিন শ্রেণিকে লক্ষ্য করে কাজ করতে পারে। তৃতীয় একটি বিষের জন্য তারা ওষুধ যোগ করে তৈরি করেন একটি অ্যান্টিভেনম ককটেল।
ইঁদুরের ওপর করা ওই অ্যান্টিভেনম পরীক্ষায় দেখা যায়, এই ককটেল ১৯ প্রজাতির বিষাক্ত সাপের মধ্যে ১৩টি সাপের মারাত্মক বিষ থেকে তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাকি ছয়টির বিরুদ্ধে আংশিক সুরক্ষা দিয়েছে।
ড. গ্লানভিল বলেন, এই অ্যান্টিভেনম অতুলনীয়, কারণ এটি এমন বহু ইলাপিডস প্রজাতির সাপের বিরুদ্ধে কাজ করে, যেগুলোর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর অ্যান্টিভেনম নেই।
অ্যান্টিবডিগুলোকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করছে গবেষক দলটি। সাপের কামড়ে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজারেরও মতো মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া অঙ্গহানি বা স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয় ৪ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। কিন্তু, টিমের রক্ত থেকে একটি সার্বজনীন অ্যান্টিভেনম তৈরি করা সম্ভব হলে নতুন আশার আলো দেখতে পাবে মানবজাতি।
আরটিভি/এসএইচএম