পারস্য উপসাগরের ছোট্ট একটা দেশ কাতার। এক সময়ের দরিদ্র এই দেশটি এখন শীর্ষ ধনীর একটি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই রয়েছে তাদের আর্থিক বিনিয়োগ। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করা উপসাগরীয় এ ক্ষুদ্র দেশটিতে রয়েছে আল জাজিরার মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমও। সবমিলিয়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।
চার দিনের সরকারি সফরে সোমবার (২১ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কাতার যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির আমন্ত্রণে এ সফরে যাচ্ছেন অধ্যাপক ইউনূস।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কাতারের রাজধানী দোহারে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘আর্থ সামিট-২০২৫’ এ অংশ নেবেন। পাশাপাশি কাতারের আমিরের সঙ্গে তার বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উপলক্ষে সফরটি হলেও মূল লক্ষ্য কাতারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা। এ ক্ষেত্রে কাতারের আমিরের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সম্ভাব্য বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, এলএনজি আমদানি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট ও সমাধান নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এ ছাড়া কাতার ফাউন্ডেশন পরিদর্শন ও ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মোজা বিনতে নাসেরের সঙ্গে বৈঠক, কাতারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সাদ বিন সেরিদা আল কাবিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রধান অফিস পরিদর্শনে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি ড. ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ারও কথা রয়েছে।
এই সফরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন।
এ ছাড়া দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চারজন জাতীয় নারী ক্রীড়াবিদ (ফুটবলার আফিদা খন্দকার ও শাহেদা আখতার রিপা এবং ক্রিকেটার সুমাইয়া আখতার ও শারমিন সুলতানা) প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে কাতারে যাচ্ছেন।
এ অবস্থায় অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, কাতার কীভাবে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটালো এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
প্রাকৃতিক সম্পদ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধনী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এর সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ। ব্যতিক্রম নয় কাতারও। মরুভূমির বালির নিচে লুকিয়ে থাকা বিশাল জ্বালানি ভান্ডারই দেশটির অর্থের যোগানদাতা। তবে, শুধু তেলই নয়, আরও একটি সম্পদ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। আর তা হলো প্রাকৃতিক গ্যাস।
বিনিয়োগ
কাতারের বিশাল আয়কৃত অর্থ কাজে লাগানোর জন্য গঠন করা হয়েছে ‘কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি’। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে কাতারের আয়কৃত অর্থ দেশ-বিদেশের লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা।
যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রের তালিকার প্রথম দিকে রয়েছে কাতারের নাম। এ ছাড়া জার্মানির ফোক্সওয়াগেন, বারক্লেইস ব্যাংক, এমনকি রাশিয়া সরকারের তেল কোম্পানি ‘রসনেফট’-এর বিরাট অংশও কাতারের মালিকানাধীন।
এর বাইরে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের একটা অংশের মালিক কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি। এমনকি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এয়ারপোর্টেরও একটা অংশের মালিক তারা।
এদিকে কাতার এয়ারলাইনস পৃথিবীর অন্যতম সেরা এয়ারলাইনসের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই খাত থেকে প্রচুর আয় করে দেশটি। এ ছাড়া আল জাজিরাসহ একাধিক চ্যানেল রয়েছে দেশটির। এসব খাত থেকেও বেশ লভ্যাংশ আসে তাদের। ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলেরও আয়োজক ছিল দেশটি।
বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও সড়ক ব্যবস্থা, এয়ারপোর্ট, বন্দর, গবেষণা কেন্দ্র আর বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে কাতার সরকার। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শিক্ষা খাত, প্রতিরক্ষা খাত, জনশক্তি আমদানিতেও প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির।
বিশ্বে কাতারের গুরুত্ব
সারাবিশ্বে কাতারের গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধ, বন্দিমুক্তিসহ যেকোনো কঠিন সমস্যাগুলোতে কাতারকে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে।
যেমন- ইউক্রেন থেকে শুরু করে লেবানন, সুদান, ইরান, আফগানিস্তান এবং ফিলিস্তিনের গাজা সংকটের মধ্যস্থতা করেছে কাতার। পাশাপাশি ২০১৭ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইরাকে আটক জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় সাহায্য, ২০১৯ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে আটক দুজন পশ্চিমা জিম্মির মুক্তিতে মধ্যস্থতা, ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখা ও গত বছর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে বন্দী বিনিময়েও কাজ করেছে দেশটি।
এর বাইরে, তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে সমঝোতা আলোচনায় স্বাগতিক দেশ হিসেবেও কাজ করেছে কাতার। এ ছাড়া ২০১৪ সালে দেশটি গাজায় ইসরায়েলি সংঘাতের সময়ে মধ্যস্থতা করেছিল।
কাতারের উদারনীতি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব
সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতিতে বিশ্বাসী কাতার। ১৯৯৫ সালে শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি কাতারের আমির হওয়ার পর থেকে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে মধ্যস্থতাকারীর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো যেসব ‘রাষ্ট্র নয় এমন সত্ত্বা’ যেমন বিভিন্ন আদিবাসী ও সশস্ত্র-বাহিনী— যাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত নয়, এমন সব প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করে কাতার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী, হামাস এবং ফিলিস্তিনের অন্যান্য সংগঠন যেমন ইসলামিক জিহাদ।
পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য পক্ষ
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর বাইরে কাতারকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মনে করে। শুধু তাই নয়, দেশটির প্রশাসন জিম্মিদের মুক্তির বিষয়েও কাতারের ভূমিকার বার বার প্রশংসা করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে এর আগে ইসরায়েলের জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে কাতারকে নিয়ে জানায়, কাতার আমাদের দীর্ঘদিনের অংশীদার এবং তারা আমাদের অনুরোধে সাড়া দিচ্ছে। কারণ আমাদের মনে হয়, তারা বিশ্বাস করে যে, নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের মুক্তি দেওয়া উচিত।
কাতারের নাগরিক জীবনমান
কাতারে বর্তমানে বৈধ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান অনেক উচ্চ। স্থানীয় নাগরিকরা বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এ ছাড়া সেখানে বেকারত্বের হারও অনেক কম।
আরটিভি/আইএম/এআর