১৯৭১ সালে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষিত হয়। রাজধানী ঘোষণার পর ১৯৭৪ সালে প্রথম আদমশুমারিতে ঢাকায় জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। ২০২২ সালে এসে এই শহরে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ কোটির ওপরে। প্রতিদিন ঢাকায় বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে খাবার পানির চাহিদা। এই চাহিদা মেটাতে ঢাকা ওয়াসা কর্ম-পরিকল্পনা করেছে। এসব কর্ম-পরিকল্পনা নিয়ে আরটিভি নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করা হচ্ছে। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক আলম।
আরটিভি নিউজ : রাজধানীতে যেসব সেবা সংস্থা রয়েছে, এরমধ্যে ঢাকা ওয়াসা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এই সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বের প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?
প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসায় এমডি পদে ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখি সংস্থাটির প্রতিটি সেক্টরে বিশৃঙ্খলা। পানি সংকটে মানুষের হাহাকার, বিল পরিশোধে বিশৃঙ্খলা, পাইপলাইন লিকেজসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত। এই অগোছাল সংস্থার দায়িত্ব পেয়ে ভিষণ টেনশনে ছিলাম। কীভাবে বিশৃঙ্খল ওয়াসাকে একটি শৃঙ্খলা সংস্থায় ফেরানো যায়, সেই চিন্তা প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে হয়েছে। সবচেয়ে অনুপ্রেরণার বিষয় হচ্ছে- ঢাকায় ওয়াসার ব্যবস্থাপক পরিচালকে যোগদানের পর পরই সাবেক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। তখন মন্ত্রী মহোদয় আমাকে বলেছিলেন- আপনার প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার আস্থা রয়েছে। আপনি রাজনীতি করেন না কিন্তু আপনার কর্মের দ্বারা সরকারকে ডুবাইতে পারেন আবার সরকারকে উঠাইতেও পারেন। বাংলাদেশের প্রাণ কেন্দ্র রাজধানীতে পানির সংকট হলে দেশের সর্বত্র এর প্রভাব পড়বে। কাজেই রাজধানীতে যেন কোনোভাবেই পানি সংকট না হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্যারের সেই কথা অনুসরণ করে প্রতিমুহূর্তে ঢাকা ওয়াসাকে পরিবর্তনের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আজকে ঢাকা ওয়াসার এই অবস্থানে আসার পেছনে বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বর্তমানে ওয়াসা মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ে যেভাবে সাজানো হয়েছে, এটি বজায় রাখতে পারলে ভবিষ্যতে সংস্থাটির ভেতরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি দেখা দেবে না।
আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসার কর্মকাণ্ড বরাবর সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকছে। এই সমালোচনার কারণ কী?
প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসা নিয়ে যারা সমালোচনা করেন বা করছেন, তারা দুটি কারণে সমালোচনা করেন। প্রথমত- কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলে ওয়াসায় কাজ করতে এসেছেন। তাদের স্বার্থে আঘাত পড়ায় ঢাকা ওয়াসা নিয়ে সমালোচনা করছেন। আগে অনেকেই ঢাকা ওয়াসাকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারতেন। এখন তাদের সেই স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত- ঢাকা ওয়াসায় রাজনীতি। রাজনীতির মতাদর্শের কারণে অনেকে বিরোধিতা করছেন। কারণ, ওয়াসা জনগণকে পানি দিতে পারলে সরকারের অর্জন। আর পানি সংকট থাকলে সরকারের ব্যর্থতা। সুতরাং রাজনীতির বড় ভূমিকা রয়েছে ঢাকা ওয়াসা। কাজেই ওয়াসা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা কমবেশি জড়িত রয়েছে।
আরটিভি নিউজ : ওয়াসা কীভাবে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে?
প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান কেন্দ্র। আর এই কেন্দ্রে কোনো সমস্যা হলে পুরো দেশে কমবেশি প্রভাব পড়বে। ২০০৮ সালে পানি সংকটে ঢাকাবাসী অর্ধেক বেলা পানি পেতেন আর অর্ধেক বেলা পানি পেতেন না। সেই ভোগান্তি থেকে মানুষ রেহাই পেয়েছেন। এখন ওয়াসার পাইপলাইনে ২৪ ঘণ্টাই পানি থাকে। রাজধানীতে পানি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক মহল আন্দোলন কিংবা সমালোচনা করতে পারেন না। অথচ রাজধানীতে পানি সংকট থাকলে অনেকেই নগরবাসীকে উসকে দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করতেন। ওয়াসার পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে পারা, এটি সরকারের বিরাট অর্জন। পানি ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে পেরেছে। প্রতিষ্ঠানে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে অল্প সময়ে ওয়াসার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। ওয়াসার এই সফলতার পেছনে সকল কর্মচারী, কর্মকর্তা এবং সর্বোপরি জনগণের সহযোগিতা আছে।
আরটিভি নিউজ : ১২ বছরে ঢাকা ওয়াসা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল ?
প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসাতে ২০০৯ সালে পরিবর্তন আনার জন্য ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ নামে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। আর এই কর্মসূচির আওতায় মাস্টারপ্ল্যান করে সংস্থাটি। মাস্টারপ্ল্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রাজধানীতে পানির সংকট নিরসন ও স্যুয়ারেজ লাইন উন্নয়ন করা। এ ছাড়াও মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে বহু মেগাপ্রজেক্ট নেওয়া হয়। ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’র কর্মসূচি নেওয়ার পর গত ১২ বছরে ঢাকা ওয়াসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজধানীবাসী ওয়াসার সুফল পাচ্ছেন। কাউকে এখন আর খাবার পানি সংকটে ভুগতে হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার সূচকে ঢাকা ওয়াসা একটি সম্মানজনক অবস্থান পৌঁছেছে।পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান ও ভারতের নয়াদিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, কলকাতা শহরের পানি ব্যবস্থাপনার তুলনায় ঢাকা ওয়াসার সূচক ভালো। এই সূচক এক দিনে তৈরি হয়নি, বছরে পর বছর পরিশ্রমের ফলে ঢাকা ওয়াসা বর্তমান অবস্থানে এসেছে।
আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসা পানির পাম্প স্থাপনে জমি অধিগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কি না?
প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়গুলো ওয়াসার উন্নয়নকে কেন্দ্র করে এগিয়েছি। রাজধানীর মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ বারের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার জীবদ্দশায় ঢাকা ওয়াসার দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের অবহেলা করিনি। তবে আমার নিজের অজান্তে ঢাকা ওয়াসার কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে ভুলত্রুটি হলে সেটি পরবর্তীতে বুঝতে পারলে সমাধানের চেষ্টা করেছি। ঢাকা ওয়াসার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং ছিল রাজধানী বাসির পানির সংকট দূর করা। বিভিন্ন এলাকায় পানির পাম্প বসাতে হবে। কিন্তু তাৎক্ষণিক পানির পাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও সেটি সম্ভব হয়নি। কারণ, ঢাকায় এক কাঠা জমিও কেউ ছাড়তে চায় না। বিভিন্ন এলাকায় ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব জমি নেই। জমির সংকট নিয়ে দীর্ঘদিন টানাহেঁচড়া শুরু হয়। তখন পানির পাম্প বসানোর আগেই পানির সংকট দূর করতে কিছু পানির গাড়ি কেনা হয়। অন্যদিকে পানির পাম্প বসানো নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হয়। সেখানেও ছিল চরম প্রতিবন্ধকতা। কারণ, ঢাকার এক কাটা জমি কেউ ছাড়তে রাজি নয়। এরপর পরিকল্পনা করা হলো- সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কোন এলাকায় জমি রয়েছে, সেখানে পানির পাম্প বসানো যায় কি না। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি যখন হয়েছি তখন বুঝেছি জমির সংকট কেমন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জমিতে ওয়াসার পানির পাম্প বসাতেও চিঠি চালাচালি ও সংস্থাগুলোর অনিহা ছিল চরমে। জমি পেলেও সেটি পাম্প বসানোর উপযোগী নয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মাঝেও ঢাকা ওয়াসা বর্তমান জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা ওয়াসায় পানির পাম্প বসাতে জমি সংকট সব সময় থাকছে। এ অবস্থার মধ্যেও নগরবাসীর চাহিদার তুলনায় ওয়াসা বেশি পানি উৎপাদন করছে। এখন ঢাকা ওয়াসাকে নিয়ে সকলেই গর্ব করতে পারেন।
আরটিভি নিউজ : ডিজিটালাইজেশনে ঢাকা ওয়াসা কোন অবস্থানে রয়েছে?
প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : বর্তমানে ই-সেবায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ই-বিলিং, ই-জিপি, ই-পানি ও পয়োসংযোগ, ই-নথি, ই-রিক্রুটমেন্টসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই ডিজিটাল সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এ ছাড়া পানির পাম্পে এসসিএডিএ স্থাপন করে ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ দ্বারা গভীর নলকূপের অপারেশন, কন্ট্রোল ও মনিটরিংয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে ঢাকা ওয়াসা পরিচালন ব্যয় কমিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অন্যদিকে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং বাস্তবায়নের পদেক্ষপ গ্রহণ করা হয়েছে। আইওটি ও জিআইএস ব্যবহার করে স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রক্রিয়া চলমান। এর মাধ্যমে সব মিটার, বাল্বসহ অন্যান্য সবকিছুর ডিজিটালাইজেশন সম্পন্ন করবে ঢাকা ওয়াসা।
এফএ