‘যদি তুমি এক শ মানুষকে সাহায্য করতে না পার, তাহলে অন্তত একজনকে সাহায্য করো। আজ সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ। উইকিপিডিয়ায় এই দিনটিতে চোখ রাখলে দারুণ সব তথ্য বের হচ্ছে। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। মাদার তেরেসার মৃত্যুদিবস আজ। ১৯৯৭ সালের আজকের দিনে মারা যান মহিয়সী এই নারী। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পালিত হয় আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস।
দিবস পালনের কী আছে?
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, দিবস কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ? কোনো কাজে আসে এগুলো? অযথা টাকা নষ্ট, সারাদিন প্যানপ্যান! আসলে অতীতের বিশেষ কোনো ঘটনা রোমন্থন, কিংবা জনসচেতনতা তৈরি অথবা কোনো বিশেষ কিছু যেন মন থেকে কখনোই হারিয়ে না যায়, এসব কারণেই মূলত দিবস পালিত হয়।
জন্মদিন পালনের কথাই ধরা যাক। অনেকে ঘরোয়াভাবে; কেউ একাকী চুপিসারে দিনটা অনুভব করেন; কেউবা হৈ-হুল্লোড়ভাবে পালন করেন। এগুলো তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক দিবস। ব্যক্তি নিজে কিংবা তার আশপাশের মানুষ এগুলো পালন করেন। কিংবা ধরুন কেউ মারা গেল, সেটাও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কিন্তু যখন সেই ব্যক্তি এমন বিশেষ কেউ হন যে, তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা গর্বের, আবেগের কিংবা জাতি হিসেবে তাকে মনে রাখাটা উচিত; তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে স্মরণে আনাটা কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের দেশে অনেক দিবস পালিত হয়। গুরুত্বের বিচারে কোনোটা খুব দারুণভাবে পালিত হলেও কিছু দিবস অগোচরেই থেকে যায়। কোনো কোনো গণমাধ্যম হয়তো আবেগঘন কোনো লেখন দিয়ে থাকেন। কেউ কিছু কাজ করেন, তবে সেটা শুধু ওই দিনটির জন্যই। পরদিন যে লাউ সেই কদু। পরিবর্তন দেখতে চাই আমরা, পরিবর্তন না করেই!
আন্তজার্তিক দাতব্য দিবস আজ!
১৯৭৯ সাল। এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার যেন মাদার তেরেসার জন্যই বরাদ্দ। তার মহৎ কর্মের সম্মাননা এবং স্বীকৃতি ছিল এটা। আর তাই মানুষটা চলে যাওয়ার পরেও যেন দিয়ে গেল নতুন এক দিবসের জন্ম, International Day of Charity। আন্তর্জাতিকভাবে ছুটির দিন!
৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭। বিশ্বের কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ধরিয়ে দিয়ে নীরবে বিদায় নিলেন মাদার তেরেসা। সম্মাননা জানাতে তাঁর মৃত্যুদিবসই হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস। দিবসটির লক্ষ্য খুব সুন্দর। অভাবী মানুষকে সাহায্য করা, দান ও সেবার মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্বে জনসচেতনতা তৈরি। উদ্দেশ্য মহৎ-যত ধরনের স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর সবটার কার্যক্রম সবস্তরে উন্নীত করা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষণা আসে ২০১২ সালে আর এরপর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি স্বীকৃত।
দিবসটি পালিত হচ্ছে ২০১৩ সাল থেকে। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে দারিদ্র্য। এর মাঝে অনেকে হয়তো ভালো থাকছেন; কিন্তু তলিয়ে যাওয়া মানুষের খবর আমরা জানি না। এই সংখ্যাও নেহায়েত কম না। এর মাধ্যমে সমাজের একটা অংশ ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে বসেছে। আমরা অনেকে টের পাচ্ছি না বা দেখেও দেখি না। এই অংশটাকে উপরে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। এজন্য দাতব্য, বিনামূল্যে চিকিৎসা, দানকর্ম এগুলো ছাড়া তাদেরকে ঠেলে তোলার আর কোনো উপায় আছে?
এই দিবস আমাদের অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়। একের দুর্দিনে অন্যের সামান্য এগিয়ে আসাটাও হয়তো অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম! রাষ্ট্রের একটা লক্ষ্য আছে। ২০৩০ এর মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা। এর জন্য করণীয় আছে। একার প্রচেষ্টায় এই কর্মযজ্ঞ কি সম্ভব?
দান নিয়ে ধর্ম কী বলে?
কথায় বলে, খাবারের অভাবে যতটা না মরে তারচেয়ে বেশি মরে ভালোবাসার অভাবে! ঘরভর্তি সম্পত্তি কিংবা বিলাসিতায় ডুবে থাকা মানুষও একটু আন্তরিক মায়ার জন্য হাহাকার করে। কঠিন প্রাণটাও যত্ন চায় দিনশেষে। এই যত্ন, সেবা কিংবা মানবতা শুধু যে মানুষের প্রয়োজন, তা নয়। পশুপাখিও যত্ন বোঝে। সেবা, স্বেচ্ছাশ্রম, দান এগুলো বুঝতে কিংবা এতে প্রাণ লাগিয়ে কাজ করতে লাগে বিশাল হৃদয়। এজন্যই হয়তো করোনা মহামারি কিংবা সিলেটসহ দেশের আরও কয়েক জায়গার বন্যা আমাদেরকে দাতব্যের প্রায়োগিক শিক্ষা দিয়ে গেছে।
দান শব্দটির সাথে পরিচিত আমরা সকলেই। মজার বিষয় হলো, প্রতিটা ধর্মেই দানশীল হওয়া, দান করার এক অপূর্ব মাহাত্ম্য আছে। যেমন ধরুন, সনাতন ধর্মে অনেকগুলো ভাগ আছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ একটি ভাগ। কথিত আছে, এই ব্রাহ্মণরা বৈদিক যুগে ভিক্ষা করতেন। তাছাড়া সনাতন ধর্মের পুরান অনুসারে, দানকে মহৎ কাজ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এমনকি প্রাচীন গুরুকুলে প্রচলিত ছিল দান।
আবার ইসলাম ধর্মের কথা যদি বলি- এ ধর্মে দান করার সাওয়াব অনেক। হোক তা প্রকাশ্যে বা গোপনে। তবে গোপনে দানের ক্ষেত্রে এখানে জোর দেওয়া হয় বেশি। দানের গুরুত্ব বুঝতে হলে এ ধর্মের জাকাত এবং ফিতরার দিকে নজর দিলেই ভালো করে বোঝা যাবে। ভালো যে-কোনো কাজের জন্যই এ ধর্মে সাওয়াব বরাদ্দ।
বৌদ্ধ ধর্মে দানকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে। যিনি দান করেন, তার আত্মা বিকশিত হয় পরিশুদ্ধতার দিকে। কী দারুণ বিষয়গুলো! একটা কাজের জন্য সকল ধর্ম প্রায় একই কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন, এর কতটা সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে?
এক যে ছিলেন মাদার তেরেসা!
১৯১০ সালে জন্ম মাদার তেরেসার। একজন সন্ন্যাসিনী এবং ধর্ম প্রচারক। ১৯২৯ সালে ভারতে যান। সেখানের নাগরিকত্ব পান ১৯৪৮ সালে। সেখানে নিঃস্বদের সহায়তায় নিয়োজিত করেন নিজেকে। বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও প্রশংসিত কাজের জন্যই নোবেল শান্তি সহ অনেক পুরস্কার পান।
নানান দেশ, তার ভেতরে বসত করে নানান ধরনের জাত, এদের আবার নানান ধর্ম, তাদের আবার নানান নিয়ম। তবে সব ধর্মের মধ্যে কিছু জায়গাতে বেশ মিল, নাম এর মানবতা। প্রতি বছর এ দিনটায় মানবতা এবং মাদার তেরেসার অক্লান্ত পরিশ্রমকে সম্মাননা জানাতেই যেন এই নীরব আয়োজন। ৮৭ বছর বয়সে আজকের এই দিনে ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
একটু কৌতূহলের বিষয় হলো- মাদার তেরেসার মৃত্যুর দিনটিতেই কেন আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস!
একজন নিবেদিত প্রাণ রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলী ছিলেন মাদার তেরেসা। ১৯৫০ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। প্রথমে ভারতে এবং পরবর্তিতে অন্যান্য দেশগুলোতেও মিশনারিজ অব চ্যারিটির কার্যালয় স্থাপন করা হয়। সমাজের দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ অসহায় মানুষের সেবায় দীর্ঘ ৪৫ বছর নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে, কোনো প্রশ্ন না রেখেই। এমন বিশাল হৃদয়ের এক মানুষকে হারিয়ে ফেলা কি চাট্টিখানি কথা? তাঁকে তো মনে রাখতে হবে। তিনি তো হৃদয়ে থাকা মানুষ।
মানুষ তাঁকে ভালোবাসতো। সনাতন ধর্মের অনেকেই তাঁকে পূজা করতো ভগমানরূপে। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি ধনী লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সাহায্য নিয়ে আসতেন। আর এ কাজের জন্য লজ্জাকে তিনি বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিতেন না। তাঁর বিশেষত্বটা এখানেই। যে জায়গায় লজ্জার কথা ভেবে আমরা থমকে দাঁড়াই সেখানে কারও মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।
দাতব্য থেকে শেখার কিছু আছে?
নানান কিসিমের মানুষ, নানান তার জাত, সাথে বিভক্ত হয় নানান সম্প্রদায়ে। যখন কেউ দান করছে কিংবা কেউ দান নিচ্ছে, কে কোন সম্প্রদায়ের তা জানার কিন্তু প্রয়োজনই হয় না, খেয়াল করে দেখেছেন? এখানে মুখ্য সেবা বিনিময়, অন্যভাবে বললে জাতিগত সমতা আনয়ন। অনেকে প্রশ্ন করেন, কী লাভ দান করে? শেখার কী আছে এখানে? উদারতার শিক্ষার জন্য দানের উপরে কিছু নেই।
কে নারী, কে পুরুষ তা দেখার কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য বড় সমস্যা। চারদিকে একবার তাকান। দেখুন, চারপাশে অনেক মানুষের নীরব আর্তনাদ চলছে। কেউ প্রকাশ করতে পারছে, কেউ পারছে না। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার কেউ নেই, পাশে বসে দুটো ভালো কথা কিংবা সাহস দেওয়ার কেউ নেই। চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে অনেকে। দেখেছেন? আরও দেখুন, পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক শিশুরা থাকছে। আমরা দায় এড়াতে ওদের নাম দিয়েছি পথশিশু। ওরা কী খাচ্ছে, কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে, আমরা সে খোঁজ নেই না। অথচ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের মতোই সমান সুবিধা পাওয়ার কথা ছিলো ওদের। কতোটা পাচ্ছে ওরা? দায় এড়াতে এখানেও রাষ্ট্রের ঘাড়ে দোষ দেই আমরা। কিন্তু রাষ্ট্রের একার পক্ষে আর কতো? আমাদের ইচ্ছার ঘাটতি আছে, নইলে ওদের জন্য কেন কেউ কিছু করছি না?
অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। কিন্তু সে চাকায় পিষ্ট হচ্ছে দারিদ্র্যের খাতায় নাম লেখানো কিছু মানুষ। একজনের দানে একজন পিষ্ট হওয়া মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোটা একটা চ্যালেঞ্জ না হলেও পারতো যদি- দাতব্য স্বেচ্ছাশ্রমে আগ্রহ নিয়ে মানুষের উপস্থিতি বাড়তো। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে কী হবে না, সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু অনেকের জীবন-জীবিকা হাতড়ে উপায় খুঁজছে বেঁচে থাকার। পরিস্থিতি আঁচ করা যায় একটু? একটু একটু করে সবার সাহায্য এক হলে সেটা কিন্তু আর ক্ষুদ্র থাকে না। খুব বেশি কর্পোরেট হয়ে গেছি আমরা। মুখে শতভাগ কর্পোরেট অ্যাটিচিউড ঝুলিয়ে আমরা দায় এড়িয়ে রাষ্ট্রের ঘাড়ে দোষ দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বসি- ‘মানবতার সংজ্ঞা! সে আবার কী?