ঢাকাশুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১

বঙ্গবাজারে আগুন : আমাদের টনক নড়বে কবে?

আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ যুবায়ের

বুধবার, ০৫ এপ্রিল ২০২৩ , ০৫:০০ পিএম


loading/img

১.

বিজ্ঞাপন

বসুন্ধরা শপিং মলে ২০০৯ ও ২০১৬ সালে আগুন লাগে। এ ঘটনায় ৭ জন মারা গিয়েছিল। ২০১৭ সালে আগুন লাগে গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে। ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ ফের আগুন লাগে এ মার্কেটে এবং পুড়ে যায় মার্কেটের একাংশ। ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আগুন লাগে কাওরান বাজারের হাসিনা মার্কেটে।

সবশেষ, ৪ এপ্রিল ভোরে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটল রাজধানীর বঙ্গবাজারে। এ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে প্রায় তিন হাজার দোকান। ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার। এখনো আগুনের ঝুঁকিতে আছে ঢাকার এক হাজার ৩০০টি শপিংমল।   

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জহির উদ্দিন বাবর বলেন, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু আমার জানামতে এ মার্কেটে আশানুরূপ তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

তিনি আরও বলেন, আমরা ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা দিয়ে দোকান নিতে পারি, কিন্তু কয়েক হাজার টাকা খরচ করে সেফটি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে পারি না। কারণ কী?
যদিও ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের একজন ব্যবসায়ী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তাদের মার্কেটে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিল। এরপরেও কেন আগুন নেভানো গেল না, এটাই তার প্রশ্ন? আশঙ্কা প্রকাশ করে এই ব্যবসায়ী আরও বলেছিলেন, এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা ষড়যন্ত্র। 

৪ এপ্রিল ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজারকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিলাম আমরা। ব্যানারও টাঙ্গিয়েছিলাম। ১০ বার নোটিশ দিয়েছিলাম যে, এই ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিসের যা যা করণীয় সবই করেছে। এরপরেও এখানে ব্যবসা চলছিল। 

বিজ্ঞাপন

ফায়ার সার্ভিসের ডিজি এবং ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ বিশেষজ্ঞদের মতে, শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। এ ছাড়াও বঙ্গবাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটের ভেতরে এত ঘিঞ্জি পরিবেশ যে, শ্বাস ফেলা কষ্টকর হয়ে যায়। ফলে, কোনোভাবে একবার আগুন লাগলে তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। 

বঙ্গবাজারের অনেক ব্যবসায়ীদরে মতে, এ আগুন নাশকতা। গুলশান-১ ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগলে, তখনও অনেক ব্যবসায়ী বলেছিলেন সেটা নাশকতা ছিল।

আগুনের ঘটনা নাশকতা কিনা তা তদন্তের পর জানা যাবে। 

প্রশ্ন হলো, হাতে গোনা কয়েকটা শপিংমল ছাড়া বাকিগুলোতে কী আদৌ যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে?  বিশেষ করে, পুরনো মার্কেটগুলোর পরিবেশ কী আদৌ ব্যবসা করার উপযোগী? এত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কেন তারা ব্যবসা করছেন? সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নোটিশ দেওয়া সত্ত্বেও, কেন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না?  

২.

৪ এপ্রিল গণমাধ্যমকর্মীদের ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, এই ভিডিওটা দেখেন, আমি নিজে করেছি। কোন জায়গা দিয়ে আমরা ফায়ার সার্ভিস কাজ করব? কোথায়? কীভাবে? অর্থাৎ বঙ্গবাজার মার্কেটের পরিবেশ এতটা ঘিঞ্জি যে, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কাজ করার মত কোনো সুযোগ ছিল না। 

অতীতে চকবাজারের আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস একই সুরে কথা বলেছিল।  পুরান ঢাকা এবং পুরনো মার্কেটগুলোসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান এখনো অত্যন্ত ঘিঞ্জি। রাস্তাগুলো অনেক সরু। যেখানে চওড়া রাস্তা আছে, সেগুলোও স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দখল করে রেখেছে। কেউ সেখানে বসিয়েছে দোকান। কেউ আবার গড়ে তুলেছে বাস, ট্রাক ও লেগুনা স্ট্যান্ড। ফলে প্রয়োজনের সময় প্রবেশ করতে পারে না ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য গাড়ি। 
রাস্তাঘাট দখল করে এবং সরু রাস্তা চওড়া না করে, আমরা-ই- কী আমাদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি না?

৩.

গণমাধ্যমকর্মীদের ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, বঙ্গবাজারে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পানির স্বল্পতা তাদের বাধা ছিল। এজন্য তারা সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়েছে। 

টেলিভিশনে আমরা দেখেছি, হেলিকপ্টার হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়ে তা বঙ্গবাজারে আগুন নিয়ন্ত্রণে ছিটাচ্ছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে পানি নেওয়া হয়েছে হাতিরঝিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পুকুর থেকে। অথচ ঘটনাস্থলের খুব কাছেই হল, বুড়িগঙ্গা নদী। বুড়িগঙ্গা থেকে ফায়ার সার্ভিস পানি নিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু এরচেয়ে বড় সত্য হল, বুড়িগঙ্গা থেকে পানি নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের জন্য সহজ কাজ ছিল না। 

ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা ও তুরাগসহ বিভিন্ন নদী আজ দখলদারদের দখলে। আগুন লাগলে, তা দ্রুত নেভাতে পানির উৎস হিসেবে নদীর যে কত প্রয়োজন, তা কী এখন বুঝতে পারছেন দখলদাররা? এবার কী দখল ছেড়ে নদীগুলো মুক্ত করে দিবেন তারা?

৪.

ঢাকা শহরে ভয়াবহ যানজট এখন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুঃখজনক হল, যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখি আমরা। ফলে অনেক অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মারা যায়। সময়মত পৌঁছতে পারে না ফায়ার সার্ভিস। যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। যদিও বঙ্গবাজারের আগুনের সঙ্গে যানজটে ফায়ার সার্ভিস আটকে যাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

আমাদের আরও মানবিক হওয়া দরকার। দায়িত্বশীল আচরণ দেখানো এখন সময়ের দাবী। যদি আমরা মানবিক হই এবং আচরণে দায়িত্বশীল হই, তাহলে যানজটে আটকে থাকবে না অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস। বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না কোনো রোগী। দ্রুত নেভানো সম্ভব হবে আগুন।

৫.

আমি ফায়ার সার্ভিসের একজন কমিউনিটি ভলিন্টিয়ার। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, অগ্নিকান্ডের খবর শুনলে ফায়ার সার্ভিস তাদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু উপরে উল্লেখিত বাধার কারণে তারা তাদের সেবা দিতে পারে না। এটা ফায়ার সার্ভিসের দোষ নয়। 

৪ এপ্রিল ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে হামলা করা হয়েছে। ফায়ার ফাইটারদের মারা হয়েছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক। আগুনে নিজের সম্পদ পুড়তে দেখলে, মাথা ঠিক থাকবে না। এমনটাই স্বাভাবিক। তাই বলে ফায়ার সার্ভিসের ওপর হামলা করা যৌক্তিক কোনো কাজ নয়।

আসুন, এবার একটু ভাবি, অনেক হয়েছে আর নয়। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশগুলো সংস্কার করে ব্যবসা করার উপযোগী পরিবেশে পরিণত করি। যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখি। সরু রাস্তা চওড়া করি। নদীগুলো দখলমুক্ত করি। যানজটে ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স আটকে না রাখি। মাথা ঠান্ডা রেখে যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করি।

 

লেখক: কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ডিজিটাল অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া, আরটিভি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |