ইংরেজিতে একটা কথা আছে “be you” (বি ইউ)। শব্দ দুটো যখন কাউকে আমরা বলি, এর মানে আমরা এটা দিয়ে বুঝাচ্ছি, ‘আপনি যা, তাই থাকুন’। মনে করে দেখুন, এ শব্দদ্বয় আমরা অনেকবার বলেছি, লিখেছি। বিশেষ করে কাউকে যখন খুব হতাশ দেখি, বিষন্ন দেখি। একটু সান্ত্বনা আর উৎসাহ দিতে আমরা তাকে বলি- ‘মন খারাপ করো না, just be you’ (জাস্ট বি ইউ)।
দিনপঞ্জিকা জানাচ্ছে আজ মে মাসের ২২ তারিখ। মজার একটা দিবস আছে আজ। International Being You (ইন্টারন্যাশনাল বিং ইউ)। আচ্ছা, কখনও কি নিজেকে নিয়ে একটু ভেবে দেখা হয়েছে যে, আসলে আমরা কী? ভেতর থেকেই বা আমরা কেমন? এই যে শতভাগ ঠিকঠাক থাকার আর দেখানোর একটা প্রয়াস, আমরা কি আসলেই এমন?
প্রায় প্রতিটা মানুষ কোন না কোন একটা মুখোশে আবৃত। না, কোনো নেতিবাচকতার জায়গা থেকে বলা হয়নি কথাটা। খেয়াল করে দেখুন, সমাজ কিংবা পরিবার, শিক্ষাকেন্দ্র কিংবা কর্মস্থল সবটাতেই অনেকটা মেকি রূপ ধারণ করে থাকি আমরা। হয়তো আমাদের খুব রাগ হয়েছে কিন্তু রাগের কারণটা বুঝতে না দিয়ে আমরা এড়িয়ে এসেছি। আবার কখনও খুব কষ্ট পেয়েছি কিন্তু বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক থেকেছি আমরা। হয়নি এমন?
কিন্তু দিনের কখনও না কখনও এ মুখোশ আমাদেরকে খুলে ফেলতেই হয়। দিনের একটা সময়ে আমরা ঠিক তেমন হয়ে যাই, আসলে আমরা ভেতর থেকে যেমন। একটু মিলিয়ে দেখুন। আমরা এ মূহুর্তে যে যেমন আছি, প্রত্যেকেই অন্যের চাহিদার কারণে। বিষয়টা এমন, ধরুন- আপনার মন চাচ্ছে কোন গল্পের বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখতে কিন্তু আপনার হাতে অজস্র কাজ। শেষ কবে বই ধরেছেন মনেও পড়ে না। আবার ধরুন আপনার মন চাচ্ছে কোন এক খোলা ময়দানে এ-মাথা, ও-মাথা ছুটে বেড়াতে। অথচ আপনার বাড়ির ছাদে যাওয়ারও ফুরসৎ মেলে না। আমরা প্রত্যেকেই কিছু দায়িত্বের গণ্ডিতে বেঁধে আছি, যে গণ্ডিতে আটকে থেকে আর যা-ই হোক নিজের মতো থাকা কিংবা হওয়া একদমই সম্ভব না। ফলশ্রুতিতে আমরা ঠিক তা-ই হয়ে উঠেছি যা আমাদের চারপাশের মানুষ চেয়েছেন। এর মানে, অনেকের চাওয়ার সমষ্টিই আমাদের বর্তমান রূপ।
প্রতিটা মানুষ কিছু স্বতন্ত্র ক্ষমতা আর বৈশিষ্ট নিয়ে জন্মায়। আর এটা খুব স্বাভাবিকভাবে বরণ করে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর। অন্যের সাথে তুলনা এবং বিচার করার বিষয়গুলো অনেকক্ষেত্রে আমাদের আনন্দে থাকার বিষয়গুলোকে যেমন কমিয়ে দেয়, তেমনি বাড়িয়েও দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-অনেকেই ঘুরতে পছন্দ করেন। প্রযুক্তির কল্যাণে সেগুলো ভ্লগ আর কন্টেন্ট হিসেবে আমরা দেখতেও পাই। দেখে অনেক কিছু শিখি, জানি। এসব ভ্লগ আর কন্টেন্টের মন্তব্যের ঘরগুলো দেখেছেন কখনও? অনেকের কৌতূহলের পাশাপাশি অনেকের হতাশার দীর্ঘশ্বাসও কিন্তু জ্বলজ্বল করে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, কিছু মানুষ অন্যের আনন্দ দেখে খুশি হওয়ার পরিবর্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কারণ এমন আনন্দ তারা ভোগ করতে পারছেন না। অথচ বিষয়টাকে সহজভাবে দেখা যেতো চাইলেই, ভাবা যেতো- কারও সুযোগ হয়েছে বলেই ঘুরে এসেছে। সবার জীবনে একরকম সুযোগ কখনই আসে না, এটা অনেকেই মানতে নারাজ।
সে হিসেবে দিনটা কিন্তু একটু হলেও আমাদের সুযোগ করে দিচ্ছে, আসলে আমরা কী তা নিয়ে একটু ভাবার। দিনটিতে এমন কিছু করুন যা আপনি করতে চান অনেকদিন ধরে, কিন্তু করা হচ্ছে না। নিজেকে বুঝিয়ে আসছেন কোন একদিন ঠিক করবেন। কেমন হয় আজকেই সেদিনটা হলে? আজকের দিনটা No Judgemnent (নো জাজমেন্ট) হলেই বা কেমন হয়? বিশেষ করে নিজের জন্য। দিন না নিজেকে একটু বিরতি। কীভাবে আপনি আরও বেশি আপনি হয়ে উঠবেন সেটা নিয়ে কিছু কি ভেবেছেন? ভেবে দেখুন আপনার মধ্যে কিছু ব্যাপার আছে যা আপনাকে নিজের মতো থাকতে সাহায্য করে। একইসাথে আপনাকে ভীষণরকম আনন্দ দেয়। আজকে সে দিন যে দিনটায় আপনি আসলে ভেতর থেকে যেমন, তেমনই থাকবেন।
অনেক কিছুইতো আমরা খুঁজে বেড়াই। এমন-কী সেটা অন্যের দোষ হলেও রেহাই দেই না। চলুন একটা কাজ করি। আজকের দিনটা আমরা নিজেদের ভেতরের দিকে একটু নজর দেই। আমাদের কতটা সৌন্দর্য আছে আর কতটা দোষ ভেতরে পুষে রেখে আমরা কেমন হয়ে আছি তা একটু পরখ তো করাই যায়, কী বলেন?
দিবসের কথা এলে পালন করা কিংবা উদযাপনের একটা বিষয় থাকে। তাহলে তো আজকের দিনটাও পালন করাই লাগে। একটা দিনের জন্য নিজের জীবনের চালক না হয় নিজেই হয়ে যান। নিজেই নিজেকে খুশি করুন, আনন্দ দিন, কৌতূহলী হন নিজেকে নিয়ে, সাথে কৃতজ্ঞ হন নিজেকে সবসময় নিজের সাথে পেয়ে।
আমাদের অনেকে ভেতরে ভেতরে অনেক গুণ পুষে রাখে। কেউ খুব ভালো গাইতে জানে। কেউ খুব ভালো লিখতে পারে, কারও আবৃত্তি খুব ভালো, কেউ খুব সুন্দর কথা বলতে জানে। এই যে গুণগুলো, এগুলো একটু চেখে দেখলে কেমন হয় বলেন তো? এ বিষয়গুলোই বের করে আনে একটা মানুষ থেকে আরেকটা মানুষ কতটা আলাদা। আদতে আমরা প্রতিটা মানুষই আলাদা।
দিনটি মূলত এ কারণেই যাতে আপনি আপনাকে উদযাপন করতে পারেন। একটা কাজ করতে পারেন। নিজেকে নিয়ে কিছু লিখে ফেলতে পারেন। কিংবা একটা ভিডিও তৈরি করতে পারেন। লোকদের জানতে দিন আসলে আপনি কেমন। লিখতে পারেন আপনার সম্পর্কে কিছু ব্যতিক্রম কিছু নিয়ে, যেটার জন্য আপনি আপনার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ।
কী-ই বা হবে একটা দিন যদি অন্যের বিচারে নিজেকে অভিযুক্ত না করেন আর নিজে যা, তা নিয়েই কৃতজ্ঞ থাকেন। ভেবে বলুন তো, লোকের কথায় বদলে যাওয়া নিজেকে দিনশেষে চিনতে একটু হলেও অন্যরকম লাগে না?
আমাদের অনেকের একটা খারাপ ব্যাপার আছে। আমরা লোকেদের বাধ্য করি তা হতে, যা তারা নয়। অথচ উচিৎ কী জানেন? মানুষগুলো আদতে যেমন, তেমনই তাকে প্রস্ফুটিত হতে দেওয়া। কেউ খুবই অন্তর্মূখী, কী দরকার তাকে লোকসমাজে জোর করে টেনে আনার? অথবা, কেউ প্রচণ্ড মিশুক, থাকুক না সে তার মতো। এবং আপনিও। যেমন আপনি, তেমন থাকুন। তবে খেয়াল রাখতে হবে নিজের মতো থাকা যাতে আরেকজনের সমস্যার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক: লামিয়া তানজিন মাহমুদ
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, ডিজিটাল অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া, আরটিভি।