ঢাকামঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

জীবনের গল্প: বাবাহীন এক মেয়ে

শাকিলা করিম

শনিবার, ১৭ জুন ২০২৩ , ০৬:৩০ পিএম


loading/img

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকর্মীর কাছে জানতে চাইলাম বাবা দিবসের বিষয়ে। তাকে জিজ্ঞাসা করতেই দূরে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে ছল ছল চোখে তাকিয়ে বললেন, আমার বাবা নেই। কথাটা প্রচণ্ড নাড়া দিল আমাকে। এরপর তার কাছে আর কিছু জানতে চাইনি। আমার সামনে বসা সহকর্মীর দুচোখে তখন অশ্রুধারা। 

বিজ্ঞাপন

একটু পর সে নিজেই বলতে শুরু করলো, বাবাকে যখন হারিয়েছি তখন আমি খুব ছোট। এতোটাই ছোট, মৃত্যু কি জিনিস এটাই জানি না। সাড়ে ৬ বছরের আমি আজও আবছা আবছা মনে করতে পারি, মামনি বলে ডাক দিয়ে শক্ত পোক্ত দুটি হাত তুলতুলে আমায় কোলে তুলে নিতো। পেশায় প্রকৌশলী বাবা আমায় বুকে জড়িয়ে বলতো, মিষ্টি মেয়ে আমার... তুমি বড় হয়ে একদিন ডাক্তার হবে। আর মাকে বলতো, আমার মেয়েকে আমি রাজকন্যার মতো যত্নে রাখবো। মেয়ের কোন শখ আমি অপূর্ণ রাখবো না।

সত্যি বলতে বাবার স্মৃতি বলতে ২৩ বছর আগের এটুকুই আমার সম্বল।

বিজ্ঞাপন

বাড়ি মফস্বলে হওয়ায় আমাদের বাড়িতে পুকুর ছিলো। আব্বু মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগের কথা। ভরা বর্ষায় পুকুরে নেমে পা ফসকে পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম। কথাটা আব্বুর কানে যেতেই ছুটে এসে পুকুর থেকে টেনে তোলেন আমাকে। সেদিন নাকি আব্বু খুব কেঁদে ছিলেন।

১৯৯৯ সালের ২৭ নভেম্বর। আব্বু যেদিন মারা যান, সেদিন সকালে আমাকে আর ভাইয়াকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন। দুপুরে খবর পাই সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত আমার আব্বু। বিকেলে খবর আসে, আব্বু আর নেই। ছোট্ট আমি, আব্বু নেই মানেটা তখন বুঝিনি। সন্ধ্যে হতে না হতে বাড়ি ভর্তি সব আত্মীয় স্বজন। সত্যি বলতে আমার বেশ আনন্দ হচ্ছিল। অনেক রাত অবধি আব্বু কেন বাড়ি আসছে না। এটা আর মাথায় নেই। সবাই বেশ আদর করছে। এটা ওটা খাবার কিনে দিচ্ছে। মনে একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার। পরদিন ভোরে আব্বুর দাফন হয়ে গেলো। আমার ছোট্ট মনের আকাশে তখনো আমার আব্বু সুপার হিরো হয়তো কাজ শেষে ঘরে ফিরবে বলে আশা।

কিন্তু আমার আব্বু আর ফেরেনি। কিছু দিন যেতে না যেতেই বদলে যেতে লাগলো চেনা মানুষগুলোর আচরণ। আগের মতো আর আমাদের বাড়ি আসে না। কেউ আদর করে কোলে তুলে নেয় না। সবাই কেমন অচেনা। আসলে এখন বুঝি, সত্যি বলতে আব্বু মারা যাওয়ার পর আমাদের দুই ভাইবোনের পড়ালেখা বা দৈনন্দিন খরচের খাতা অনেক ভারি। যা বয়ে নেওয়ার ভয়ে সরে পড়ে আমার চিরচেনা কথিত সব রক্তের সম্পর্কগুলো।

বিজ্ঞাপন

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম বন্ধুদের বাবারা তাদের নিতে এসেছে। বাবার হাত ধরে যখন ওরা হেঁটে যেতো। আমি তখন দু’চোখ ভরে সে দৃশ্য উপভোগ করতাম। আমার বাবা থাকলে হয়তো আমাকেও নিতে আসতো। পরে চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে প্রায় দিনই মাকে জিজ্ঞেস করতাম, আব্বু কবে ফিরবে?

বিজ্ঞাপন

এখন আমি অনেক বড় হয়েছি। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। ইচ্ছা বা মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে আব্বুর স্বপ্নের ডাক্তার আমি হতে পারিনি। তবে সাংবাদিকতা পেশায়ও আমি ভালো আছি। যদি আব্বু দেখতেন, নিশ্চয় খুশি হতেন। এখন বুঝি আব্বু আমার অন্য ভুবনের বাসিন্দা। কিন্তু মাঝের সেই সময়টা আজও ভুলিনি। আজও যখন অন্যকে দেখি বাবার হাত ধরে হাঁটছে, অজান্তেই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।

সেদিন গভীর মনোযোগে আমি আমার সহকর্মীর কথাগুলো শুনেছিলাম। সবশেষে সে বলেছিলো, পৃথিবীর যে কোন কিছুর বিনিময়ে যদি আরেকটি বার আমার বাবার দেখা পেতাম….তার চোখে আমি দেখেছিলাম গভীর হাহাকার।

সে সময় কথা গুলো শুনে বাকরুদ্ধ আমি ভাবছিলাম, বাবাহীন জীবন আসলে কেমন জীবন। তপ্ত মরুভূমির বুকে ছায়াহীন জীবন।

সব সন্তানের মাথার ওপর অটুট থাকুক বাবা নামক বটবৃক্ষটি। বাবা দিবসে বিশ্বের সব বাবার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: নিউজরুম এডিটর, আরটিভি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |