ফেব্রুয়ারিতে দেশের এক বিশিষ্টজনের বাসায় গেলাম। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। নানান গল্প করছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি কথার মাঝেই হঠাৎ চোখ মুছলেন। প্রথমে খেয়াল করিনি, পরে বিষয়টি নজরে এলো। লজ্জা, সংকোচ, দ্বিধা আর ভয়কে ভুলে প্রশ্ন করে বসলাম- ‘কী হলো, ভাই? কোনো সমস্যা নাকি?’ তিনি বললেন, ‘জিয়া হক, সন্তানদের লেখাপড়া করাইছি ঠিকই। মানুষ করতে পারিনি।’ ততক্ষণে দেখলাম, একজন টগবগে তরুণ হাতের হেলমেট টেবিলে রাখছেন। উচ্চবাচ্চ করছেন। বুঝতে বাকি থাকলো না, এই তরুণই বিশিষ্টজনের আদরের ধন!
কথায় কথায় বেলা বাড়ল। মাগরিবের পর আবার আড্ডা। কত যে কথা! কথারা ফুরায় না। বিশিষ্ট মানুষটি স্বেচ্ছায় বলে চলছেন জীবনের নানান অভিজ্ঞতার কথা। বলা না-বলা জীবনযুদ্ধের কথা। অব্যক্ত কষ্টের কথা। এমনকি ছাত্রজীবনে সারাদিন না-খেয়ে থাকার কথা। বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে হেঁটে হেঁটে টিউশনিতে যেতাম। ১০-১২ কিলোমিটার পথ হাঁটতাম। দেখা গেল দুপুরে কিছুই খেতে পারিনি। আসলে খাওয়ার সামর্থ ছিল না।
টিউশনির বাসার বিকালের নাস্তাই ছিল আমার বিকাল-সন্ধ্যা বা রাতের একমাত্র খাবার। চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম, কখন নাস্তা আসবে! এমনও হয়েছে, খাবার চেয়ে খেয়েছি। আবার কখনো টিউশনি থাকত না। তখন রাতের খাবার বাদ। আবার মাঝে-মধ্যে দলীয় অফিসে যেতাম। কয়েক দিন যাওয়ার পর একটা লোকেশন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জুটত। দুই-তিনবার যাওয়ার পর কিছু টাকা দিত। কয়েক দিন চলে যেত সেই টাকায়।
মানুষটির কথা মুগ্ধ হয়ে শুনি। হ্যাঁ-না, ও, আচ্ছা এসব ছাড়া তেমন কিছু বলি না। প্রায় ৭৪ বছর ছুঁই ছুঁই এই লড়াকু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘এই বাড়িটি আমার। আমি চাকরিজীবনের টাকাপয়সা তিল তিল করে জমিয়ে, কিছু ঋণ করে শেষ আশ্রয়টুকু গড়েছি। আজ আমারই আশ্রয় নেই। আমাকে থাকতে হয় ভাড়া বাসায়। তাও নিজের টাকায় ভাড়া মিটাতে হয়।’
যাইহোক, আরো অনেক কথাই হলো সেদিন। পরে এক ছোটভাইকে বিষয়টি শেয়ার করি। ব্যক্তির নাম-পরিচয় গোপন রাখি। ছোটভাই বললেন, ‘অমুককে চেনেন? আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড তো, মনে হয়।’ নাম লিখে সার্জ দিলাম। হুম, বন্ধু তো। তার মানে ফেসবুক ফ্রেন্ড আমার। তার বায়োতে বাবা নিয়ে হুমায়ূন আহমদের সেই বিখ্যাত প্রবাদপ্রতিম বাণী সাঁটানো। অথচ এই ব্যক্তি তার বাবা-মাকে পিটিয়ে ঘর ছাড়া করেছেন। জোর-জবরদস্তি করে সব জমি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছেন। আরও নানান ঘটনা। অথচ ফেসবুক বায়ো!
২. সত্যিকারের চিত্র সহজে চোখে পড়ে না। ফেসবুকের অনেক ‘রাজা-বাদশা’ বাস্তবে টোকাই। আবার ফেসবুকের অনেক ‘টোকাই’ বাস্তবে ‘রাজা-বাদশা।’ তার মানে, ফেসবুক বা সামাজিক কোনো মাধ্যম কাউকে শতভাগ চিনিয়ে দেয় না।
বাস্তবে অনেকে বাবা-মা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে সামান্য মাথা ঘামান না। কিন্তু ফেসবুকে তিনি চে গেভারার মতো বিপ্লবী। সত্যি বলতে কী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা নেটদুনিয়ায় আসল চেহারা ফুটে ওঠে না। অনেকে এটাকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেন। সামান্য একটা লাইকের জন্য আদিম-যুগে ফিরতেও দ্বিধা করেন না। এসব কম-বেশি সবার জানা।
৩. এত কথা বললাম, শুধু বাবা দিবসকে কেন্দ্র করে। জুন মাসের তৃতীয় রোববার ‘বিশ্ব বাবা দিবস।’ বাবা দিবস নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেই ফেব্রুয়ারির ঘটনা সামনে এলো। এমন ঘটনা অনেক।
কিন্তু বাবার বিষয়টি বুঝতে বেশি উদাহরণ না দিই। মনে করিয়ে দেই, সন্তানের জন্য বাবার ভালোবাসা অসীম, অকৃত্রিম ও স্বার্থহীন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি ঘটনা সবাইকে হতচকিত করে। বাবরপুত্র হুমায়ুন জটিল রোগে আক্রান্ত হলেন, বাঁচার কোনো আশা রইল না। সম্রাট বাবর রোগগ্রস্ত পুত্র হুমায়ুনকে বাঁচাতে আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তার নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষার। হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন, আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সম্রাট বাবর।
অন্যদিকে, এক বাবা একজন পুত্রসন্তান পেতে অস্থির, তার স্ত্রী পরপর নয়টি কন্যাসন্তান জন্ম দেন। এর পরের সন্তানটি হয় পুত্র, বাবা পরম শান্তির সঙ্গে পুত্রসন্তানের মুখ দেখে আনন্দে আত্মহারা হন। ধীরে ধীরে ছেলেটি বড় হতে থাকে, সব মেয়ের বিয়ে হয়, তারা স্বামীর বাড়িতে চলে যায়। একসময় বাবা যখন বৃদ্ধ অবস্থায় পতিত হন, ওই আদরের ছেলেটাই বাবাকে বোঝা মনে করতে থাকে। কোনো একসময় বাবা একটি ছোট্ট আবদার করে বসেন, এতে ছেলেটি ক্ষিপ্ত হয়ে বাবাকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে ফেলে আসে।
৪. উপরের দুটি ঘটনাই কম-বেশি সবার জানা। এসব জানা-শোনার পরও এই সময়ে বেড়ে চলছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। বাবা-মাকে ফেলে দিয়ে আর কখনো খোঁজ-খবরও নেন না সন্তানরা। এমনকি মরদেহ পর্যন্ত দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন না।
বাবা দিবসে সব বাবাকে জানাই অতল শ্রদ্ধা। সত্যিকারের বাবা মাত্রই লড়াকু। সন্তানের জন্য সব বিলিয়ে দেওয়া দাতা ‘হাতেম তাই’। বাবা দিবসে এমন হাজারো স্ট্যাটাস, লেখা চোখে পড়ে। ভাইরাল হয়। বাবা দিবসেই আমার ছোট্ট প্রশ্ন, এত এত ফেরেশতার মতো বাবার দেশে এত দুর্নীতি কেন? এত অপরাধ কেন? এত বৈষম্য কেন? এসবে কারা জড়িত? তারা কি কারো প্রাণের বাবা না?
আমরা ভালো বাবা হওয়ার সাথে সাথে ভালো মানুষ হই। ভালো মানুষ মাত্রই ভালো বাবা, ভালো বাবা মাত্রই ভালো মানুষ নয়। বাবা ভালো মানুষ হলে সন্তানও ভালো মানুষ হবেন। ভালো বাবা হবেন। ভালোয় ভালোয় আলোকিত হবে জীবন-জগৎ।