• ঢাকা শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১
logo

বাংলাদেশের চাকরির বাজারে লিঙ্গ ও ধর্মীয় পোশাকের বৈষম্য

আরটিভি নিউজ

  ৩০ জুলাই ২০২৩, ১৬:৩৭
চাকরি
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের চাকরির বাজারে মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড, দাঁড়ি-টুপি বা হিজাবের মতো ধর্মীয় পোশাক, এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য আছে কিনা এ নিয়ে ‘‘Labor Market Discrimination in Bangladesh: An experimental Evidence from the job market of college graduates” শীর্ষক শিরোনামে একটা গবেষণা করেছেন মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক- শিব্বির আহমদ, প্রফেসর সংচিন জিন, ড. ভেরোনিক থেরিঅল এবং বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন গবেষণা বিভাগের লিড ইকোনোমিস্ট ড. ক্লাউস ডেইনিঙ্গার।

গবেষণাটি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত এগ্রিকালচারাল এন্ড অ্যাপ্লায়েড ইকোনোমিক্স অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্সে প্রেজেন্ট করেছেন গবেষকদলের প্রতিনিধি মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক শিব্বির আহমদ।

এই স্টাডিতে গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন চাকরি প্রার্থী তার হাইস্কুল (এসএসসি এবং এইচএসসি) কোন ধরণের প্রতিষ্ঠানে পড়েছে (মাদরাসা বা জেনারেল স্কুল), তার জেন্ডার, কিংবা ধর্মীয় পোশাক (যেমন- ছেলেদের ক্ষেত্রে দাঁড়ি-টুপি, মেয়েদের হিজাব) পরার কারণে কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার হয় কিনা! বৈষম্য থাকলে তার মাত্রা কতটুকু এবং বিভিন্ন সেক্টরে সেটা কিভাবে ভ্যারি করে?

গবেষণাটি করার জন্য তারা চারজন পুরুষ ও চারজন নারীর মোট ৮টা কাল্পনিক সিভি (fictitious resume) বানিয়ে এনজিও, কর্পোরেট, মিডিয়া, ও আইটি সেক্টরে পাঠিয়েছে। সিভিগুলো সমান রাখার জন্য সবাইকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বা কাছাকাছি ধরণের বিভাগ থেকে দেখানো হয়েছে; এবং তাদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ও অন্যান্য যোগ্যতা সমান রাখা হয়েছে।

চারজন পুরুষের দুজন মাদরাসা থেকে দাখিল আলিম পাশ করা, দুজন জেনারেল স্কুল থেকে এসএসসি এইচএসসি পাশ করা। মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই রাখা হয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপের দুটোসিভির একটিতে ধর্মীয় পোশাক সহ (দাঁড়ি-টুপি/হিজাব) সহ ছবি দেয়া হয়েছে, অন্যজনকে জেনারেল পোশাকে রাখা হয়েছে; মাদরাসা এবং স্কুল দুই ব্যাকগ্রাউন্ডের ক্ষেত্রেই।

প্রায় দশ মাস ধরে বিডিজবস, প্রথম আলো জবসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো ফলো করে গবেষকরা ৪০৬টা চাকরির পজিশনে ৩২৪৮টা সিভি পাঠিয়েছে; প্রতিটা জবে আটটা করে।

গবেষকরা দেখতে চেয়েছেন একজন এমপ্লয়ার প্রাথমিক বাছাইয়ের পর কাদেরকে ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকে, সেক্ষেত্রে প্রার্থীর হাইস্কুল ডিগ্রী, ধর্মীয় পোশাক, বা লিঙ্গ কোনো ব্যবধান তৈরি করে কিনা। প্রত্যেক সিভির বিপরীতে একটা করে ফোন নাম্বার ও ইমেইল আইডি ছিলো যা দুজন গবেষণা সহকারী মেইনটেইন করেছে। নারী কাল্পনিক সিভিগুলো মেইনটেইন করার জন্য একজন নারী এবং ছেলেদের সিভিগুলো মেইনটেইন করার জন্য একজন পুরুষ গবেষণা সহকারী কাজ করেছেন।

সংক্ষেপে তাদের গবেষণার ফাইন্ডিংসগুলো হচ্ছে:
১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েট যাদের দাখিল আলিম মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো, অন্যান্য সকল যোগ্যতা সমান থাকার পরেও তারা চাকরির বাজারে বৈষম্যের শিকার হয়। জেনারেল স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরি প্রার্থীদের সমান সংখ্যক ইন্টারভিউ কল পেতে হলে তাদেরকে সামগ্রিকভাবে অন্তত ৪০ শতাংশ বেশি চাকরিতে আবেদন করতে হয়। পুরুষদের জন্য সেটা আরো তীব্র। যদি শুধু মাদরাসা ও স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের দুজন ক্লিনশেভ করা পুরুষের মধ্যে তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীকে ১৭১ শতাংশ বেশি চাকরিতে আবেদন করতে হবে সমান সংখ্যক ইন্টারভিউয়ের ডাক পেতে। চারটি সেক্টরেই এই বৈষম্য বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান।

২) একইভাবে দাঁড়ি-টুপি, হিজাবের জন্যও বৈষম্য বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে হিজাবী নারীদের চেয়ে দাঁড়ি-টুপি আছে এমন পুরুষ প্রার্থীরা বেশি বৈষম্যের শিকার হন। এনজিওতে হিজাবের কারনে বৈষম্য না থাকলেও দাঁড়ি-টুপি বা মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের কারনে পুরুষরা কম কল পেয়েছে। ধর্মীয় পোশাকের কারণে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হয় মিডিয়া ও কর্পোরেট সেক্টরে। আইটি সেক্টরে মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য বৈষম্য থাকলেও ধর্মীয় পোশাকের ভিত্তিতে বৈষম্য পাওয়া যায় নি।

৩) জেন্ডারের ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য কোন ভিন্নতা দেখা যায়নি। এনজিওর চাকরিতে বরং নারীরা অনেক বেশি প্রায়োরিটি পায় (সেখানে পুরুষ ক্যান্ডিডেটরা বরং বৈষম্য ফেস করে)। নারীর প্রতি বৈষম্যতার বিরুদ্ধে গত দু-তিন দশকের সচেতনতার সুফল হিসেবে এটা হয়েছে। তবে নারীরা তুলনামূলক কম বেতনের চাকুরিতে এবং ক্লায়েন্ট-ইন্টারেকশান বেশি এ ধরণের চাকুরিতে বেশি কল পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমলেও নারীদের কম বেতনের চাকরিতে প্রায়োরিটি এখনো বেশি। ইন্টারেস্টিংলি, মিডিয়া জবে নারীরা তুলনামূলক কম কল পেয়েছে। সমান যোগ্যতার নারী ও পুরুষ আবেদন করলে মিডিয়া পুরুষ প্রার্থীকে তুলনামূলক বেশি প্রায়োরিটি দেয়।

বাংলাদেশে জব মার্কেটে বৈষম্য আছে বলে মানুষের মধ্যে পারসেপশান থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো রিসার্চ-ইভিডেন্স নেই। এটা প্রথম গবেষণা যার মাধ্যমে বৈষম্যের বিদ্যমানতা প্রমাণিত হয়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়েও হাইস্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে জব মার্কেটে বৈষম্য অনুসন্ধান করার গবেষণা এটি প্রথম। অত্যন্ত অবজেক্টিভ জায়গা থেকে বৈষম্য যাচাই করার ক্ষেত্রে দুনিয়া জুড়ে এ পদ্ধতি (audit/correspondence experiment) খুবই প্রশংসনীয় একটা পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশেই বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক গবেষণা করা হয়েছে।

গবেষকদল আশা করেন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এ গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে চাকরির বাজারের বৈষম্য দূরিকরণে ভূমিকা রাখবে, যথোপযুক্ত বৈষম্য-বিরোধী নীতি গ্রহণ করবে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট চাকরি প্রার্থীদের সিভিতে ছবি ও এসএসসি এইচএসসি বা সমমানের পর্যায়ের ডিগ্রী সম্পর্কিত তথ্য মেনশান করার প্রথা বাতিল করলে প্রাথমিক বাছাইতে বৈষম্য কমে আসবে। যদিও বৈষম্য দূর করতে সামগ্রিক নীতি নির্ধারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকরা। বৈষম্য না করে শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতেই চাকরি হলেদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগ্যরা ভূমিকা রাখতে পারবে। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

গবেষণার ফলাফল অন্যান্য যেসব বৈশিষ্ট্যের কারনে বায়াস হতে পারে সেগুলো গবেষকরা কন্ট্রোল করেছেন। যেমন হাইস্কুল বা মাদরাসাগুলো মোটামুটি সমমানের রেখেছেন (ঢাকা শহরের পরিচিত স্কুল ও মাদরাসা), এসএসসি এইচএসসি জিপিএ, বিভাগ সমান রেখেছেন। মাদরাসায় যেহেতু বাণিজ্য বিভাগ নেই সেহেতু স্কুলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও সেটা রাখা হয়নি; হয় সবাই বিজ্ঞান বিভাগের, বা সবাই মানবিকের; এসএসসি এইচএসসি তে একই গ্রুপ রাখা হয়েছে। ইংরেজি মিডিয়াম বা ভার্সনের স্কুল বা মাদরাসা রাখা হয় নি যাতে ইংরেজিতে ভালো বা উচ্চবিত্ত মনে করে বায়াস না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের বিভাগ সমান বা কাছাকাছি রাখা হয়েছে যে বিভাগগুলোতে ভর্তি হতে হলে ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণত সমান মানের ফলাফল করতে হয়। এগুলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে এই কাল্পনিক সিভিগুলোর প্রার্থীরা সবাই সমানভাবে যোগ্যা।

প্রার্থীদের নাম, ঠিকানা, ছবিগুলো এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে নাম-ঠিকানা দেখে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়ে মনে করে বায়াস তৈরি না হয়। প্রার্থীদের অভিজ্ঞতা, রেজাল্ট, কো-কারিকুলাম অভিজ্ঞতা, ও অন্যান্য দক্ষতা সমান রাখা হয়েছে। যেসব জবের জন্য ইংরেজি ভাষা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হতে পারে সেখানে সব প্রার্থীদের সমান IELTS স্কোর মেনশান করা হয়েছে যাতে বুঝা যায় সবার ইংরেজির দক্ষতা সমান।

জবগুলোতে যে ধরনের যোগ্যতা-দক্ষতা চেয়েছে সিভিগুলো সেভাবেই সাজানো হয়েছে যাতে সিভি দেখে ওভার-কোয়ালিফায়েড বা আন্ডার-কোয়ালিফায়েড মনে না হয়। গবেষণাটি সংক্রান্ত যেকোনো যোগাযোগের জন্য নিচের ইমেইলে যোগাযোগ করা যেতে পারে- ahmadsib@msu.edu

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
আশুলিয়ার পোশাক কারখানাগুলো খুলছে শনিবার
‘বাংলাদেশ থেকে পোশাক উৎপাদনের বড় একটি অংশ ভারতে চলে যেতে পারে’
চরমপন্থা মোকাবিলায় ধর্মীয় ঐক্যের ডাক দিলেন পোপ ফ্রান্সিস
গোপন গ্রুপ নিয়ে মুখ খুললেন মৌসুমী