প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। তিনি বলেছেন, প্রতিটি নাগরিকের উচিত তার জমি থেকে কিছু না কিছু উৎপাদন করা। যে যা পারি, তা উৎপাদন করতে হবে। শুধু নিজেদের নয়, দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর করতে আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর এই তৎপরতায় দেশ রক্ষা পেয়েছে মহাসংকট থেকে। না হয় কোভিড-পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও দেশে খাদ্যে সংকট নেই বললেই চলে। এই খাদ্য সংকট পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন ১৫ বছর আগে। যার ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেশে তো রয়েছেই, সারা বিশ্বেও এমন মডেল নজিরবিহীন। দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে স্থায়ী তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে যাত্রা হয় এই প্রকল্পের, যা দিয়ে হতদরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পেরেছেন।
এ প্রকল্পে যদি ৬০ লাখ সদস্য থেকে থাকে, তাহলে এর মধ্যে ৪০ লাখই নারী সদস্য। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ গৃহিণী নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার এক নিভৃত লক্ষ্য বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি সমাজকে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার শিক্ষাও দিয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি গ্রামের ৬০ জন (৪০ জন নারী ও ২০ জন পুরুষ) দরিদ্র বা হতদরিদ্র এবং ভিক্ষুক পরিবার নিয়ে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয়। ক্ষুদ্র সঞ্চয় পদ্ধতিতে মূলধন গঠন করে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আয়বর্ধক কর্মকা- পরিচালনা করে এসব সমিতি। প্রতিটি সমিতি থেকে নির্বাচিত সুবিধাভোগীদের কৃষিনির্ভর আয়বর্ধক কর্মকান্ডের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সারা দেশে ১ লাখ ২০ হাজার ‘গ্রাম উন্নয়ন সমিতি’ গঠন করে ৫৪ লাখ ৬০ হাজার পরিবারকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করার এবং মাসে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা হারে ২ বছরের সঞ্চয় সমিতির নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। ওই অ্যাকাউন্টে দুই বছরে সমিতির সদস্যদের নামে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা হলে প্রকল্পের তহবিল থেকে সমপরিমাণ, অর্থাৎ আরও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসাবে সমিতিকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়।
সমিতির ১ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ জন সদস্যকে ভার্মিকম্পোস্টিং, ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সমিতি ব্যবস্থাপনাসহ আরও কয়েকটি বিষয়ের ওপর একদিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রকল্পের শুরুতে।
এছাড়া গ্রাম উন্নয়ন তহবিল থেকে সমিতিভুক্ত ৬০ শতাংশ পরিবারকে ঋণ দিয়ে পারিবারিক ক্ষুদ্র কৃষি খামার স্থাপন করার ব্যবস্থা করা হয় এ প্রকল্পে। একইভাবে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করে প্রতি উপজেলা ও জেলায় একটি করে অফিস কাম অনলাইন বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
গ্রাম উন্নয়ন তহবিল গঠনের পর তহবিলসহ সমিতি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অধীনে স্থানান্তর করে ওই ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক সেবা অব্যাহত রেখে সমিতির কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। এ কার্যক্রম পরিচালিত হয় দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়নে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে হতদরিদ্র মানুষের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে এনে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে নামাতে সক্ষম হয় দেশ।
কৃষিবান্ধব খামারবাড়ি পুষ্টির উন্নয়নে অন্যতম অবদান রাখছে। একটি বাড়ি যখন খামারে পরিণত হয়, তখন তা বহুমুখী সম্ভাবনাকে কার্যকর করার ক্ষেত্র হিসাবে ভূমিকা রাখে। বাড়ির আঙিনার এক চিলতে জমি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় হয়ে উঠতে পারে পরিবারের সারা বছরের পুষ্টির নিয়মিত উৎস। তাছাড়া করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এমনিতে ঘরের সামনের উঠানে নারীরা পালংশাক, পুঁইশাক, লালশাক, মরিচ, বেগুন ও টম্যাটোর চারা রোপণ করে পারিবারিক নিয়মিত সবজির চাহিদা পূরণ করে থাকে। ঘরের চাল ও মাচায় লাউ, কুমড়াগাছ লাগিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পরও কিছু বিক্রি করে তারা বাড়তি আয় করে। এসব বিষয়ে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে একজন নারী আত্মকর্মসংস্থান করে নিতে পারছেন।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প অন্যতম। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। স্থানীয় মানবসম্পদের ‘সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে’ গ্রামের প্রতিটি বাড়িকে একটি টেকসই কৃষিভিত্তিক আয়বর্ধক ইউনিট হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। কিন্তু বছরভিত্তিক বরাদ্দে অপ্রতুলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সমিতির সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ এবং খামার স্থাপনের লক্ষ্যও অনেক ক্ষেত্রে পূরণ হয়নি। অথচ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছিল আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প। এর মধ্যে ছিল:
১. গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িকে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গড়ে তোলা;
২. প্রতিটি গ্রামে ৬০ জন দরিদ্র/অতিদরিদ্র/ভিক্ষুককে নিয়ে গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন (ভিডিও) তৈরি, যার ৪০ জন মহিলা এবং ২০ জন পুরুষ সদস্য থাকবে;
৩. সদস্যদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও সরকার থেকে সঞ্চয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ অনুদান প্রদানের মাধ্যমে গ্রাম সংগঠনের জন্য তহবিল সৃজন;
৪. গ্রাম সংগঠনকে আয়বর্ধক কাজে বিনিয়োগের জন্য ঘূর্ণায়মান তহবিল অনুদান হিসাবে প্রদান;
৫. গ্রাম সংগঠনের নির্বাচিত সদস্যদের কৃষিভিত্তিক আয়বর্ধক কাজে দক্ষতা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান;
৬. সদস্যদের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ডেটা সেন্টার স্থাপন;
৭. বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশনের মাধ্যমে সদস্যদের উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে অনলাইন ব্যাংকিং ও বাজারজাতকরণ সেবা প্রদান;
৮. প্রতি ইউনিয়নে সদস্যদের জন্য বহুমুখী পাঠদানকেন্দ্র হিসাবে পল্লী পাঠশালা স্থাপন;
৯. দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণকৃত সদস্যদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ প্রদান;
১০.বার্ড কুমিল্লার Improving livelihood of rural people of Lalmai-Mainamati hill area of Comilla through integrated agricultural farming প্রকল্পটি পৃথক কম্পোনেন্ট হিসাবে বাস্তবায়ন;
১১.সমবায় অধিদপ্তরের Livelihood Improvement of the Ethnic Community through Cooperatives প্রকল্পটি পৃথক কম্পোনেন্ট হিসাবে বাস্তবায়ন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, আরটিভি