ঢাকাবুধবার, ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মহান মাতৃভাষা উৎপত্তি হয়েছিল যেভাবে 

আরটিভি নিউজ

বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ১১:১১ এএম


loading/img
ছবি : সংগৃহীত

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/বরকতের রক্ত। প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/আমায় নেবে সঙ্গে/বাংলা আমার বচন আমি/জন্মেছি এই বঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

কবিতার এই লাইনগুলো মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য মহান শহীদদের প্রাণের আত্মত্যাগের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাংলা আমার মাতৃভাষা। আর এই মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে নামা কিছু তরুণের বুকের তাজা রক্তে লাল হয় ঢাকার রাজপথ। আজ সে দিনটিকে স্মরণ করার দিন। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রাণের এই ভাষায় আমরা কথা শিখি, বলি, হাসি, খেলি-গান গাই। আমাদের প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে বাংলার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। 

এই বাংলাভাষা কোথা থেকে এলো? কীভাবে এর উৎপত্তি? আসলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে নানান জনের আছে নানা মত। তবে বাংলাভাষা একদিনে আজকের পর্যায়ে আসেনি। শত সহস্র বছরের বিবর্তনে এই রূপ পেয়েছে। এখন আমরা যে বাংলা ভাষা বলি এক হাজার বছর আগে তা ঠিক এমন ছিল না। এক হাজার বছর পরও ঠিক এমন থাকবেও না। ভাষা এমনই চলমান প্রক্রিয়া, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি সমৃদ্ধ ও নতুন রূপে বিকশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

মানুষের মুখে মুখে বদলে যায় ভাষার ধ্বনি। রূপ বদলে যায় শব্দের, বদল ঘটে অর্থের। অনেকদিন কেটে গেলে মনে হয় ভাষাটি একটি নতুন ভাষা হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই রূপন্তরের মধ্যে দিয়ে উৎপত্তি হয়েছে বাংলাভাষার। তবে এ ধারণা ভেঙে দিয়েছেন ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহসহ বেশ কজন গবেষক। তারা প্রমাণ করেন যে, সংস্কৃত থেকে নয়, প্রাকৃত ভাষা থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বাংলা ভাষার। সংস্কৃত ছিল সমাজের উঁচুশ্রেণির মানুষের লেখার ভাষা। তা কথ্য ছিল না। কথা বলত মানুষেরা নানা রকম ‘প্রাকৃত’ ভাষায়। প্রাকৃত ভাষা হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথ্যভাষা।

প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে মনের ভাব প্রকাশের নানান রীতি চালু ছিল। সেখান থেকে অঞ্চলভেদে উৎপত্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতভাষা। আমাদের এই নদী বিধৌত পূর্ব অঞ্চলের মানুষেরা যে প্রকৃত ভাষায় কথা বলতে, তা হলো মাগধী। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা মাগধি রূপান্তরিত হয়ে বাংলাভাষার উদ্ভব হয়।

ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বাংলা, আসামি ও ওড়িয়া ভাষা। তাই বাংলার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আসামি ও ওড়িয়ার। আর কয়েকটি ভাষার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা রয়েছে বাংলার সঙ্গে; কেননা সেগুলোও জন্মেছিল মাগধী অপভ্রংশের অন্য দুটি শাখা থেকে। ওই ভাষাগুলো হচ্ছে মৈথিলি, মগহি, ভোজপুরিয়া। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, গৌড়ী প্রাকৃতেরই পরিণত অবস্থা গৌড় অপভ্রংশ থেকে উৎপত্তি ঘটে বাংলা ভাষার।

বিজ্ঞাপন
Advertisement

আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরোনো ভাষার নাম ‘প্রাচীন প্রাকৃত’। কালক্রমে এর অভিহিত হয় ‘আধুনিক প্রাকৃত’ রূপে। আধুনিক প্রাকৃত ভাষা থেকে শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠে ‘গৌড়ী প্রাকৃত’, ‘মাগধী প্রাকৃত’ ইত্যাদি নামে আরও কয়েকটি প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়। কালের বিবর্তনে প্রাকৃত ভাষার আরও পরিবর্তন হয়ে নাম হয় অপভ্রংশ। এই অপভ্রংশ থেকে জন্মলাভ করে আসামের ‘অহমিয়া’ ভাষা, উড়িষ্যার ‘উড়িয়া’ ভাষা, ভারতের ‘হিন্দী’ ভাষা এবং এতদাঞ্চলের ‘বাংলা’ ভাষা।

মনে হয় প্রাচীনকালের কোন ভাষার সংস্কার করেই ‘সংস্কৃত’ নাম রাখা হয়েছে। কেননা, যা সংস্কার করা হয় সেটাই সংস্কৃত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাচীন প্রাকৃত বা আধুনিক প্রাকৃত জনগণের মুখের ভাষা। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা কখনও জনগণের মুখের ভাষা ছিল না। এখনও জনগণের মুখের ভাষা নয়। এটা হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা। ব্রাহ্মণ-ভট্টাচার্য ছাড়া এ ভাষায় পণ্ডিত হবার কারও অধিকার ছিল না।

হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজাদের যুগে বাংলা ভাষার উপর যে অত্যাচার হয়েছে তাতে বাংলা ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাংলাকে ধরে রেখেছিল, টিকিয়ে রেখেছিল। পরবর্তীকালে ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন ঘোড়ু-সওয়ার নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করার পর শুরু হলো বাংলায় মুসলিম শাসন। তাতে মুক্ত হলো সংস্কৃতি, মুক্ত হলো ভাষা। এদেশের কর্ম ও জীবনের সঙ্গে জড়িত হলো বাংলা। বাঙালি মুসলমান বাংলার প্রতি পুরোদমে আকৃষ্ট হলো। বাংলার পাঠান বাদশাগণ, আমীর-ওমরাহ এবং সাধারণ মানুষ বাংলার কদর করতে লাগলো।

তারপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর কয়েকশত বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলার জনগণ ও বাংলা ভাষার উপর নেমে আসে আবার নির্যাতন। ইংরেজ আমলে খ্রিস্টান মিশনারী ও সংস্কৃত পণ্ডিতরা বাংলা ভাষা থেকে আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ এমনকি আঞ্চলিক শব্দও বিতাড়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বাংলা ভাষাকে বিশুদ্ধ করার অপপ্রচার চালিয়ে সংস্কৃত ভাষার শব্দরাজি চাপিয়ে দেন।

ইংরেজ আমলেই ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। বাংলাকে শিক্ষার বাহন করার জন্যও তিনি জোর দাবি জানান। এরপর ১৯১৮ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনে ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদউল্লাহ ঘোষণা করেছিলেন- ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’

১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান ও স্বাধীনতা লাভে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টির পরও পূর্ব বাংলার মানুষকে নতুন করে সংগ্রাম করতে হলো মাতৃভাষা বাংলা তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ এবং তত্পরবর্তী পর্যায়েও কঠোর ভাষা-সংগ্রামের মাধ্যমে, ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। তারপর এদেশের নির্যাতিত মানুষের মরণজয়ী ভাষা-সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ও কঠিন আন্দোলনের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ১৯৭১ সালে।

বাংলাদেশ হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অংগ সংগঠন ইউনেস্কো সংগত কারণে যথোপযুক্ত বিবেচনায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বিজয়ের পর এটা বাঙালি জাতির আরেকটি মহৎ বিজয়। মে দিবস, নারী দিবস, মানবাধিকার দিবসের মতো বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে জগদ্বাসীর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এটা আমাদের জন্য পরম গৌরবের বিষয়।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |