একুশ বলে দেয় বর্ণমালার কথা

আখতার উজ জামান

বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ০২:২৮ পিএম


আখতার উজ জামান

অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, প, ত, এ, ভ, ম শ- এই অক্ষরগুলোই আমাদের প্রাণ, জয়ের গান, বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দিতে যার ভূমিকা অপরিসীম। মায়ের ভাষা কথাটির পেছনে অনেক রক্তঝরা শহীদের স্মৃতি বিজড়িত। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সফিক, সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের মতো বাঙালির রক্তের বিনিময়ে আজ এ দিনটিকে আরও বেশি স্মরণীয় করে রেখেছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র। যেমনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষও আজকের এই দিনে সম্মান জানাবে আমাদের এই ভাষা শহীদদের প্রতি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন শোষণের পর। আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলার মাটিতে এই মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি সেই রক্তঝরা শহীদদের আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তানি জান্তারা বরাবরই বাংলার মেধাবীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল মেধাশূন্য করে উর্দু ভাষাকে পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব; বাংলা মায়ের সন্তানরা এতটা দেশপ্রেমী যেখানে যে কোনো পরাশক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি কালজয়ী সাক্ষী হয়ে আছে আজকের এই বাংলাদেশ। যেই দেশটিতে আজ সবাই মুক্ত মনে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে। 

এই বাংলা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় আজ আমরা অনেক কিছুতে বিশ্ব দরবারে জানান দিতে পারছি মেধা বিকাশের মাধ্যমে। যেখানে আজ পৃথিবীর মানচিত্রে সিয়েরালিওন নামক রাষ্ট্রটি পর্যন্ত আজ আমাদের মায়ের ভাষাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ঐতিহাসিক গানটি পরিবেশন করে। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা কিংবা পর্যালোচনার ইতিহাস সবারই জানা। তারপরও এই মাতৃভাষার ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করে রাখতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পুনরায় প্রকাশ করতে হলো এই প্রজন্মের কাছে। কারণ নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি দেশপ্রেমী চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে ইতিহাসকে স্মরণ করে। উৎখাত করতে হবে ১৯৫২, ১৯৭১’র সেই পাকিস্তানি অপশক্তিকে, যারা এখনো এই দেশের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের দোহাই দিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রগতিশীল ও সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। তাই প্রায় ১৭ কোটি বাঙালি সজাগ থাকবে অপশক্তিকে প্রতিরোধ ও পরিহার করে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই স্মরণীয় দিনটিকে মনে রেখে। বাংলাদেশকে সঠিক গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে পৌঁছে দিতে এবং সরকারের পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবারও সৃষ্টি করতে হবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সফলতার পটভূমি। ভাষার লড়াইয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পর্যালোচনা:- ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ওই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়- যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন। 

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালোভী, ঔদ্ধত্য শাসকরা শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল কিভাবে কেড়ে নেবে এই বাংলা মায়ের মুখের ভাষা। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। প্রখ্যাত লেখক ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়ার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন’ নামক বইয়ের ১৭০ পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ভাষাভাষির আনুপাতিক হার পরিলক্ষিত হয়। যেখানে বাংলাভাষার আনুপাতিক হার ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, পাঞ্জাবি- ২৭.১%, পশতু- ৬.১%, উর্দু-৬%, সিন্ধি-৪.৮% এবং ইংরেজি ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ১.৪। তাহলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাভাষার আনুপাতিক হার ছিল সবচেয়ে বেশি। আর মাত্র শতকরা ৬ শতাংশ ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। 

১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় একই ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারি ঢাকাতে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে ওই দিনই এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠিত হয়। আর এই কমিটির মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ২১ ফেব্রুয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তখনকার গভর্নর নূরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল অগ্রসর হয় এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসে ঠিক তখনি পুলিশ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে মিছিল কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয় এবং রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র শহীদ হন। সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথে নেমে আসেন এবং প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। 

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের আপামর ছাত্রসমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা অর্জিত হয়েছে তার গণ্ডি তখন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির এ আত্মত্যাগ আজ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এই মাসটিকে আর স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং সরকারিভাবে বাংলাভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করা হয় এই মহান চেতনাকে কেন্দ্র করে। আজ আমরা হাসি-আনন্দ, দুঃখ বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করি মায়ের ভাষায়। তাই ভাষার এ গুরুত্বের কথা ভেবেই পৃথিবীর সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের বিনিময়ে অকাতরে জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাভাষার মর্যাদা- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- আমি কি ভুলিতে পারি।’

বিজ্ঞাপন

লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission