শবেবরাতে যে চার আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ
শবেবরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির যামিনী। ‘শবেবরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারকাত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ইসলামি তমদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে পাঁচটি রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিশেষ পাঁচটি রাত হলো: দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবে মেরাজ, শবে বরাত ও শবে কদর। যারা রাতের ইবাদতের গুরুত্ব অনুধাবন করেন, তারা প্রতিটি রাতকে শবে বরাত বানিয়ে নেন।
ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু রাত আছে। লাইলাতুল বরাত তার মধ্যে অন্যতম। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি মনোযোগী হন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৯০; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)
অনেক হাদিসে এ রাতের আমল ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
১. নামাজ আদায় করা
লাইলাতুল বরাত উপলক্ষে বিশেষ কোনো নামাজ নেই। অন্য সব রাতের মতো সাধ্যমতো নফল নামাজ আদায় করা উত্তম। আলা ইবনে হারিস (রহ.) থেকে বর্ণিত, উম্মুল মুমিমিন আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন।
আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ করে বলেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন হুমায়রা! তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন! আমি জবাবে বললাম, না! হে আল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন! রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ তাঁর রাসুল ভালো জানেন।
তখন রাসুল (সা.) বলেন, এটা অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন ও অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থায়ই। (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৬৩৫)
২. কবর জিয়ারত করা
লাইলাতুল বরাতে কবর জিয়ারত করা যায়। কবর জিয়ারতে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। রাতে কবর জিয়ারতে যাওয়া সম্ভব না হলে নিজ অবস্থান থেকেও ঈসালে সওয়াব করা যায়।
আয়েশা (রা.) বলেন, এক রাতে রাসুল (সা.)-কে ঘরে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কি ব্যাপার আয়েশা! (তুমি যে তালাশে বের হলে) তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? আয়েশা (রা.) বলেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, যখন শাবান মাসের ১৫ রাত আসে অর্থাৎ যখন শবেবরাত হয়, তখন আল্লাহপাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৯; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৬০২৮)
৩. বেশি বেশি দোয়া করা
লাইলাতুল বরাত হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত। এ রাতে বেশি পরিমাণে তাওবা-ইস্তিগফার করতে হয়। রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করতে হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, পাঁচটি রাত এমন আছে যে রাতে বান্দার কোনো দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। আর তা হলো জুমার রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, নিসফা শাবান অর্থাৎ অর্ধ শাবানের দোয়া, ঈদুল ফিতর রাতের দোয়া, ঈদুল আজহা রাতের দোয়া। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৯২৭)
৪. রাতে ইবাদত দিনে রোজা
লাইলাতুল বরাতে নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ইত্যাদি আমলে মশগুল থাকতে হয়। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়। বিশেষ রহমত লুফে নিতে হয় এবং দিনের বেলা রোজা রাখতে হয়। আলী বিন আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো আর দিনের বেলা রোজা রাখো। নিশ্চয়ই আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, কোনো গুনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে বিপদ মুক্ত করে দেব। আছে কি এমন? আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৮৮; শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৮২২)
এ রাত ঘিরে সমাজে প্রচলিত অনেক কুসংস্কার ও বিদআত আছে। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন