বাংলাদেশে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা: করণীয় ও প্রস্তাবনা

অমিত দত্ত

শনিবার, ০৯ মার্চ ২০২৪ , ০৫:৪৩ পিএম


বাংলাদেশে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা: করণীয় ও প্রস্তাবনা

বাংলাদেশের নারীরা যুগ যুগ ধরে শোষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে তাকে সর্বদা রাখা হয়েছে অবদমিত। তার মেধা শ্রমশক্তিকে শুধু সাংসারিক কাজেই ব্যয় করা হয়েছে। সমাজ ও দেশ গঠন কাজে তাকে কখনও সম্পৃক্ত করা হয়নি। নারী আন্দোলনের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন– ‘তোমাদের কন্যাগুলিকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও, তাহারা নিজেরাই নিজেদের অন্নের সংস্থান করুক।’ তাঁর এ আহ্বানে নারীর অধিকার অর্জনের পন্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তবে বর্তমান সময়ে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও লিঙ্গভিত্তিক সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবু নারীদের নিরাপত্তা, বিশেষ করে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিশ্চিত করা একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং ক্ষমতায়নের মূল চালিকা হিসেবে বিবেচিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির নানামুখী পরিবর্তন হয়। শিক্ষা শুধু যে আত্মিক বিকাশের জন্যই অপরিহার্য তা নয়; বরং শিক্ষা বর্তমানে কর্মের দৃঢ় সুযোগ এবং সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও তাদের ভবিষ্যৎ সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭২ সালে নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় রচিত এ সংবিধানে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংবিধানে ২৭ ধারায় উল্লেখ আছে যে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

২৮(১) ধারায় রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’। ২৮(২) ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন’। ২৮(৩)-এ আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষভেদ বা বিশ্রামের কারণে জনসাধারণের কোনও বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনও নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’। ২৮(৪)-এ উল্লেখ আছে যে ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের কোনও অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনও কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’। ২৯(১) এ রয়েছে–  ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে’। ২৯(২)-এ আছে–  ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’।

এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্র, অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি  বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ডিসেম্বর, ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) গৃহীত হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সালে কার্যকর হয়। নারীর জন্য আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস বলে চিহ্নিত এই দলিল নারী অধিকার সংরক্ষণের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদণ্ড বলে বিবেচিত।

বিজ্ঞাপন

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ তিনটি ধারায় [২, ১৩(ক), ১৬(ক), ও (চ)] সংরক্ষণসহ এ সনদ অনুস্বাক্ষর করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ প্রণয়ন করে, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত ও অবহেলিত এ দেশের বৃহত্তর নারী সমাজের ভাগ্যোন্নয়ন করা।

এতদসত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীর ওপর যৌন হয়রানি ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অভিভাবক মহলে দুশ্চিন্তার রেখাপাত দাঁড় করিয়েছে।

একটি গবেষণা সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী দেখা যায় যে পড়াশোনার মান নিয়ে সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীরা একই ধরনের মত দিলেও নিরাপত্তার বিষয়ে বিশাল মত পার্থক্য দেখা গেছে। পুরুষ শিক্ষার্থীদের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও নারী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত। ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোতে দুই দলের এই বিশাল মতপার্থক্য এটি স্পষ্ট করে দেয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও নিরাপদ বোধ করার মতো পরিবেশ নারী শিক্ষার্থী প্রদান করা যায়নি। বাংলাদেশের সামাজিক রীতি-নীতিতে বরাবরই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে আসছে।

বাংলাদেশে আর্থিক উপার্জনমূলক খাতে নারীর পদচারণা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় কর্মক্ষেত্রেই বেড়েছে। নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বাড়ায়, নারীদের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রের পরিধি ও অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের আওতায় শিল্প, কলকারখানা, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে। নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগ্যতা ও দক্ষতাতেও পরিবর্তন এসেছে।

সরকারি চাকরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর ২৭ শতাংশ নারী। উদ্যোক্তা হিসেবেও নারীদের উপস্থিতি নজর কেড়েছে, বিশেষত অনলাইন ব্যবসায়। গত তিন দশকে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পেছনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে কর্মজীবী নারীর নিরাপত্তা।

যৌন হয়রানির ফলে একজন নারীর কর্মজীবনে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতি, মর্যাদাহানি এবং নারীর জীবনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে, নারীর পরিবারে দুঃখ-দুর্দশা, যন্ত্রণা ও অসম্মান ভোগ করে। তাই যৌন হয়রানি বন্ধে সরকারকে আইন, বিচার ও প্রশাসন রাষ্ট্রের এই তিন অঙ্গের সবকটি দ্বারা নারীর জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রদানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। সেখানে বলা আছে, কোনও প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে সেটি তদন্ত এবং প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের এবং শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই হাইকোর্টের এই নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক গত ২০১৯ সালের ১০ জুন জেনেভাতে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির ১০৮তম সেশনে ‘Elimination of Violence and Harassment in the world of work’ শীর্ষক কনভেনশন ১৯০-এ বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি নিরসনে একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে এই কনভেনশনের প্রস্তাবনা একদিকে একটি শক্তিশালী ফ্রেমওয়ার্ক ও সুরক্ষা কবজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ বছরে শিক্ষার সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রাথমিক স্তরে ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষার হার সমান হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা মাত্র ৩ শতাংশ পিছিয়ে। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ৬ শতাংশ এগিয়ে মাধ্যমিক স্তরে। পেশাগত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে। পেশাগত শিক্ষায় নারী ৩৮ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় ৩৩ শতাংশ।

অনেক প্রতিবন্ধকতা জয় করেই এগিয়ে চলেছেন দেশের নারীরা। আকাশে বিমান ওড়াচ্ছে নারী। হিমালয়ের চূড়ায় উঠছে নারী; বন্দুক কাঁধে যুদ্ধেও যাচ্ছে। নারীর নিয়োগ বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে। রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরতদের ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী। শিক্ষায় নারীর নিরাপত্তার উন্নয়নে অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং হয়রানির ব্যাপকতা।

নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই মৌখিক অপব্যবহার, যৌন হয়রানি এবং এমনকি শারীরিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হয়, যা তাদের অ্যাকাডেমিক কর্মক্ষমতা এবং সামগ্রিক সুস্থতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তদুপরি হয়রানির অভিযোগের সমাধান এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থার অভাব সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ অভিযোগ প্রতিকারের ব্যবস্থার অভাব রয়েছে এবং হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রায়ই রিপোর্ট করা হয় না, যা দায়মুক্তি এবং নীরবতার সংস্কৃতিকে স্থায়ী রূপ দান করছে।

কিন্তু এরপরও সিংহভাগ নারীকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে। একক নারী, নারীর একক পরিবার এবং একক মা—নারীর এই পরিচয়কে সমাজ করুণার চোখে দেখে।

উন্নয়ন ও আধুনিকতার এই ডামাডোলের মধ্যেও নারীকে এক ধরনের ভয়ের পরিবেশে চলাফেরা করতে হয়। ঘরে, বাইরে, পরিবহনে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীর যতই অর্জন থাকুক কিন্তু নিরাপত্তা ও অধিকার নারীরা ঠিক সেই অর্থে পাচ্ছেন না।

অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, দেশে ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। দেশের জিডিপিতে মোট জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২০ শতাংশ। এই কাজগুলো কোনও অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে। জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেসকোর ‘শান্তি বৃক্ষ’ এবং গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিছু হতাশা থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের অর্জন অনেক। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতাভিত্তিক এক উন্নত-সমৃদ্ধ বিশ্বে প্রবেশের মাধ্যমে উন্নত দেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। প্রান্তিক নারী প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীগুলোর কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে পর্যাপ্ত নীতি তৈরি করা দরকার। যেসব আইন ও নীতি আছে, তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ অবসানে স্কুলের পাঠ্যক্রমে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এছাড়া নারীর নিরাপত্তার উন্নয়ন, সহিংসতার শিকার নারীদের আইনি সেবা পাওয়ার সহজপ্রাপ্যতা, সহিংসতা রোধে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সে বিষয়গুলো সরকার ও উন্নয়ন অংশীদারদের কার্যক্রম ও কৌশলে স্থান পাওয়া উচিত।

এছাড়াও দেশের শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

করণীয়–

১. সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠদান কার্যক্রমের শুরুতে এবং প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে।

২. নারীর প্রতি সহিংসতা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

৩. আদালতের নির্দেশনা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য সরকারি উদ্যোগে একটি তদারকি কমিটি থাকা উচিত।

৪. গণপরিসরে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা।

৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকামণ্ডলীর মাঝে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইন, প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা এবং আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৬. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধী একটি কমিটি থাকতে হবে।

৭. নারীবান্ধব অবকাঠামোগত বরাদ্দ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে নারী সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়।

৮. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিগত কোনও সম্পর্কের বিষয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি নিজস্ব নৈতিক নীতিমালা বা কোড অব কন্ডাক্ট থাকা প্রয়োজন।

৯. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নির্যাতন সেল গঠন ও তার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত করা।

১০. নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশনগুলো অনুমোদন এবং সে অনুযায়ী আইন সংস্কার জরুরি।

সর্বোপরি, নারীবান্ধব শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই পরিবেশ উন্নত হলে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে, যা আগামীর জন্য সুখী, সমৃদ্ধশালী ও টেকসই বাংলাদেশ বিনির্মাণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission