দায়িত্ব ও পদ-পদবি সম্পর্কে ইসলাম যা বলে
তিনটি বিষয়ে মানুষ মোহমুক্ত নয়—(ক) হুকুমত তথা ক্ষমতার মোহ। (খ) দৌলত তথা সম্পদের মোহ। (গ) আওরাত তথা নারীর মোহ। অথচ উপদলীয় কোন্দল, বিরোধ ও ক্ষুদ্র স্বার্থের অচলায়তন ভেঙে মদিনা সনদের ধারাবাহিকতায় প্রিয় নবী (সা.) গোত্রশাসিত ২৭৬টি দেশীয় রাজ্যকে একত্র করে প্রায় ১২ লাখ বর্গমাইল এলাকার লোকদের এক পতাকাতলে শামিল করেছিলেন।
প্রিয় নবী (সা.) তিন স্তরের প্রশাসন কাঠামো গড়ে তোলেন—কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক। কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে বিভিন্ন দপ্তরে ভাগ করে বিশিষ্ট সাহাবিদের দায়িত্ব প্রদান করেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য প্রাদেশিক পর্যায়ে নিযুক্ত হন ওয়ালি বা গভর্নর। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের জন্য আমিল বা আঞ্চলিক প্রশাসকের পদ সৃষ্টি করা হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে, ক্ষমতার মালিক মহান আল্লাহ। ‘ইন্নাল আরদা লিল্লাহ...।’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই এই পৃথিবী আল্লাহর, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করেন।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১২৮)
৬২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধের পটভূমিতে অবতীর্ণ আয়াতে আমরা খুঁজে পাই আল্লাহর বিধানের চিরন্তনতা।
ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো আর যাকে ইচ্ছা করো লাঞ্ছিত...।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২৬)
ক্ষমতা ও দায়িত্ব আমানতস্বরূপ। এটি আল্লাহর নিয়ামত।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি)
তাই ইসলামের নির্দেশনা হলো, দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ে নেওয়া যাবে না। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ। আমরা এমন কাউকে ক্ষমতায় নিযুক্ত করব না, যে দায়িত্ব চায় এবং এমন লোককেও না, যে দায়িত্ব লাভের প্রত্যাশা করে।’
আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (সা.) আমাকে বলেছেন, হে আবদুর রহমান, দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ে নিয়ো না। কারণ যদি তোমার চাওয়ার কারণে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তো তোমাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দেওয়া হবে (তুমি আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে)। পক্ষান্তরে যদি না চাইতেই দায়িত্ব ও ক্ষমতা তোমার ওপর অর্পিত হয়, তাহলে তুমি ওই বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (বুখারি, হাদিস : ৬৬২২)
ক্ষমতা ক্ষমতাবানের কাছে আমানতস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘কেউ যদি মুসলিম জনগোষ্ঠীর শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে প্রতারক ও আত্মসাৎকারী হিসেবে মারা যায়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি)
ইসলাম বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয় আদর্শগত কারণে। প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে খলিফা ওমর (রা.) হয়ে যান অর্ধ পৃথিবীর বাদশাহ। যাঁর সুশাসনের নজির হলো, জেরুজালেম বিজয়ী আমিরুল মুমিনিন টেনে নিচ্ছেন উটের রশি। ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাতের আঁধারে। তিনি বলতেন, ‘ওই ফোরাতের কূলে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমি ওমরকে আল্লাহর সমীপে জবাবদিহি করতে হবে!’
ক্ষমতা ভোগ-ব্যবহার ও শক্তির মানদণ্ড নয়। মুহাম্মদ ইবনে নাসর স্পেনে তাঁর বসবাসের জন্য আল-হামরা প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। বিজয়ী বেশে গ্রানাডায় প্রবেশকালে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে সমবেত জনতার উল্লাসধ্বনি ছিল ‘মারহাবান লিন-নাসর অর্থাৎ আল্লাহর কৃপায় বিজয়ীকে স্বাগত।’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ যদি আল্লাহ না চান, কেউ বিজয়ী নয়।
দেখা যায়, ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লির স্বাধীন সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হন। সালতানাত যুগের প্রথম দিকের শাসনকে ‘মামলুক’ বা ক্রীতদাসের যুগ বলা হতো। এমনকি সম্রাজ্ঞী নূরজাহানও ছিলেন ভারতে বিক্রি হওয়া একজন ইরানি ক্রীতদাসী।
১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি ঝাড়খণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি বনাঞ্চল দিয়ে দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করেন, তখন লক্ষ্মণ সেনের পাহারাদাররা স্রেফ ঘোড়া বিক্রেতা ছাড়া আর কিছুই তাঁকে মনে করেনি। ইখতিয়ার হলেন বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক। এভাবেই ভারতের বুকে সাড়ে পাঁচ শ বছরের (১২০৪-১৭৫৭ খ্রি.) মুসলিম শাসনের অধ্যায় রচিত হয়েছিল।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী বস্তু নয়। মানুষ ক্ষমতার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। ক্ষমতায় থাকার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, রাজ্য জয়ের জন্য, দেশ দখলের জন্য ক্ষমতাপাগল মানুষগুলো দানবের রূপ ধারণ করে। ক্ষমতান্ধদের লড়াইয়ে কেউ না কেউ জয়ী হয়। তবে সব সময় পরাজিত হয় মানবতা ও সাধারণ মানুষ। ক্ষমতায় মদমত্ত মানুষগুলো ভুলে যায়, ক্ষমতা কোনো চিরস্থায়ী বস্তু নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই দিনগুলোর (সুদিন-দুর্দিন ও জয়-পরাজয়) পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৪০)
মহান আল্লাহ সবাইকে উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মন্তব্য করুন