মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন
বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজটি সম্পন্ন করে ইতিহাসের পাতায় যিনি অমর হয়ে আছেন তিনি হলেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তাঁর জন্ম ১৮৩৪ মতান্তরে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক হলেন রাজা রামমোহন রায়। একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ‘নববিধান’ নামে এক সার্বজনীন ধর্মমত গঠন করেন। ‘নববিধান’ তত্ত্বের মূলকথা ছিল সমন্বয়ধর্ম বা ‘রিলিজিয়ন অফ হারমোনি’। গিরিশচন্দ্র সেন ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের ‘নববিধান’ ব্রাহ্মসমাজের প্রচারকব্রত গ্রহণ করেন। কেশবচন্দ্র সেনই সেসময় গিরিশচন্দ্র সেনকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী বাংলা ভাষায় অনুবাদের নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এ বিষয়ে গিরিশচন্দ্র সেন নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে বিস্তারিত তথ্যের অবতারণা করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের ‘আত্ম-জীবন’ (১৯০৭) বইটা পড়ে দেখতে পারেন।
অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’-এ লিখেছেন—‘কেশব সেন প্রমুখ চেয়েছিলেন সব ধর্মের একটা সমন্বয় করতে। এই সমন্বয়ের ধারণা থেকেই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকে ভালো করে জানার জন্য তাদের মধ্যে একটা আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয়। অবশেষে এই জানার আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য কেশব সেন উপর্যুক্ত চারটি ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বাংলায় ভাষান্তরের জন্য ব্রাহ্মভাইদের ওপর দায়িত্ব প্রদান করেন। শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন—
১. ইসলাম ধর্ম : গিরিশচন্দ্র সেন
২. হিন্দু ধর্ম : গৌরগোবিন্দ রায়
৩. বৌদ্ধ ধর্ম : অঘোরনাথ গুপ্ত
৪. খ্রিস্টান ধর্ম : প্রতাপচন্দ্র মজুমদার।’ (পৃ. ১৫৪)
এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমরা জানি, উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে ফারসি ভাষার নিগূঢ়তম সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি দীর্ঘ প্রায় পাঁচ শ’ বছর পর্যন্ত ফারসি ভাষাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। গিরিশচন্দ্র সেন পারিবারিক সূত্রে এই ফারসি ভাষা-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার লাভ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাব আলীবর্দি খানের আমল থেকেই গিরিশচন্দ্র সেনের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মুসলমান শাসন প্রণালী, ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামী ভাষা-সংস্কৃতির ছিল হৃদ্য ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
তাঁর পিতা এবং দাদা উভয়ই ছিলেন ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত। পাঁচ বছর বয়সে গিরিশচন্দ্র সেনের হাতেখড়ি বাংলায় শুরু হলেও তাঁর প্রকৃত শিশুশিক্ষা শুরু হয় একজন মৌলবীর নিকট ফারসি ভাষা শেখার মধ্য দিয়ে। এরপর সাত বছর বয়সে উপনীত হলে গিরিশচন্দ্র সেনের পিতা মাধবরাম রায় যখন দেখলেন তাঁর পুত্র ফারসি বর্ণমালা বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করতে পেরেছে তখন তিনি শেখ সাদির ‘পন্দনামা’ বইখানা নিজ হাতে লিখে ছেলেকে তা পড়তে দেন।
উল্লেখ্য যে, গিরিশচন্দ্র সেনের পিতামহ, পিতা ও পিতৃব্য সকলেই ছিলেন সুলেখক (খোশনবিশ)। তৎকালীন সময়ে ফারসি ভাষায় তাঁদের স্বহস্তে লেখা অনেকগুলো বই ছিল। অতঃপর পিতার তত্ত্বাবধানে গিরিশচন্দ্র সেন ‘পন্দনামা’ ও ‘গুলিস্তাঁ’ পুস্তক পাঠ করেন। পরবর্তীতে তাঁর নিজ গ্রাম পাঁচদোনার পার্শ্ববর্তী শানখলা গ্রামের পারস্য ভাষাভিজ্ঞ মুনশি কৃষ্ণচন্দ্র রায় যিনি বাঁকা কৃষ্ণরায় নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, তাঁর কাছে তিনি ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর কাছ থেকেই গিরিশচন্দ্র সেন— তওয়ারিখ জাহাঁগির, মাদনোজ্জওয়াহের, মহব্বতনামা, বহরদানেশ, সেকন্দরনামা, রোক্কাতে ইয়ার মোহম্মদ ইত্যাদি বড় বড় ফারসি বইয়ের পাঠ সমাপ্ত করেন। (‘আত্ম-জীবন’ পৃ.১-২; ৮-১০)
গিরিশচন্দ্র সেনের ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে এই নিবিড়-গভীর সম্পৃক্ততাই পরবর্তীতে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনকে অনুপ্রাণিত করেছিল পবিত্র কুরআন বাংলায় অনুবাদ করার কাজটি তাঁকে দিয়ে সম্পন্ন করাতে। সংস্কৃত, ফারসি ও উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত গিরিশচন্দ্র সেন এ পর্যায়ে পবিত্র কুরআন অনুবাদের লক্ষ্যে আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য প্রায় ৪২ বছর বয়সে লখনৌতে চলে যান।
সেখানে গিয়ে বিখ্যাত মৌলবী এহসান আলীর কাছে আরবী ভাষা শেখা শুরু করেন। তিনি তাঁর কাছে প্রায় এক বছর আরবী ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজ অধ্যয়ন করেন। এরপর কলকাতার একজন মৌলবী ও ঢাকার নলগোলার মৌলবী আলিমুদ্দিনের কাছে তিনি আরবী সাহিত্য ও আরব ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করেন। অতঃপর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পবিত্র কুরআন অনুবাদের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৮৫ মতান্তরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তা শেষ করেন। প্রায় পাঁচ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ, মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজ অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন গিরিশচন্দ্র সেন।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’-তে লিখেছেন— ‘ভাই গিরীশচন্দ্রের এই বাংলা তরজমার কয়েক খণ্ড প্রকাশ পাওয়ার পরই তদানীন্তন মুসলিম সমাজে এর একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। জনৈক মুসলিম তাঁকে কতল করার হুমকি দিয়েছিলেন। অপরাধ শুধু এই যে, বিধর্মী হয়ে তিনি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের তরজমা করেছিলেন। পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুসলমানই গিরীশ বাবুকে তাঁর এই বাংলা তরজমার জন্য অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কলকাতার আহমদুল্লাহ সাহেব এবং কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবী উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রবৃত্তিধারী জনাব আবদুল আলা ও আবদুল আযীয সাহেবান ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চে গিরীশ বাবুকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অভিনন্দন জানিয়ে ইংরেজিতে পত্র লিখেছিলেন। এই প্রশংসাপত্র সমকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং গিরীশচন্দ্রের অনূদিত কুরআন মজীদের প্রথম খণ্ডের শুরুতেও সংযোজিত হয়।’ (পৃ. ৫৭-৫৮)
এখানে একটি কথা না বললেই নয়— একথা সত্য যে, গিরিশচন্দ্র সেনের আগে আরো কয়েকজন পবিত্র কুরআনের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁরা কেউই পুরো কুরআনের অনুবাদ করেননি। এ কারণে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই পবিত্র কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিরতরে ঠাঁই করে নিয়েছেন। এ পর্যায়ে আমরা কয়েকজন মুসলিম মনীষীর রচনায় এবং তাঁদের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন সম্পর্কে আলোকপাত করতে চেষ্টা করবো।
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী (রহ.) (১৯০০-১৯৭২) তাঁর ‘বাংলা ভাষায় কুরআন পাকের অনুবাদ ও তফসীর’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
‘তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ নিবাসী দেওয়ান মাধব রায় সেনের পুত্র এবং নববিধান ব্রাহ্ম-সমাজের প্রবর্তক আচার্য কেশবচন্দ্র সেনের শিষ্য ছিলেন। তিনিই প্রথম পাদটীকাসহ তিন খণ্ডে কুরআন পাকের পূর্ণাঙ্গ ও গদ্যানুবাদ প্রকাশ করেন। ঢাকায় তিনি শাহ আবদুল কাদের দেহলভীর ‘মুবিহুল কুরআন’ ও তাফসীর হোসাইনীর অনুসরণ করেন। ইহার প্রথম সংস্করণ ১৮৮১-১৮৮৫ সালের মধ্যে এবং ৪র্থ সংস্করণ মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁর ভূমিকাসহ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়।
অনুবাদের নমুনা
‘দাতা দয়ালু ঈশ্বরের নামে— প্রবৃত্ত হইতেছি।
বিশ্বপালক পরমেশ্বরেরই সম্যক প্রশংসা। তিনি দাতা ও দয়ালু। বিচার-দিনের অধিপতি।
আমরা তোমাকেই মাত্র অর্চনা করিতেছি এবং তোমার নিকট মাত্র সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি।
তুমি আমাদিগকে সরল পথ প্রদর্শন কর— যাহাদিগের প্রতি তোমার আক্রোশ হইয়াছে এবং যাহারা পথভ্রান্ত, তাহাদের পথ নয়; যাহাদের প্রতি তুমি কৃপা করিয়াছ তাহাদের পথ (প্রদর্শন কর)।’ (ই.ফা.বা. প্রকাশিত মওলানা নূর মুহাম্মদ আজমীর রচনাবলী, পৃ. ২৪৮-২৪৯)
শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) ‘ভাই গিরীশচন্দ্র সেন’ (১৯৬৪) নামে সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনার মাধ্যমে তাঁর প্রতি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন—
‘এমন একজন সাধু পুরুষ ছিলেন ভাই গিরীশচন্দ্র সেন। তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, তিনি ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্রের আদেশে ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থাদি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে পাঠ করে কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা তর্জমা করেন; হযরত ইব্রাহীম, মূসা, দাউদ এবং মুহম্মদ (সঃ)-এর বিস্তৃত জীবন বৃত্তান্ত লিখে প্রচার করেন; হাদীশ মেশকাতুল মসাবীহ-এর বঙ্গানুবাদ ৪ খণ্ডে সম্পন্ন করেন; সুবিখ্যাত ‘তাপস-মালা’ গ্রন্থ রচনা করেন এবং মুসলিম ঐতিহ্যবাহী আরও কয়েকখানা পুস্তক প্রণয়ন করেন।
সুখের বিষয়, তিনি একখানা অতি অকপট আত্ম-জীবনী লিখে গেছেন, যার থেকে তৎকালীন সমাজের একটা জাজ্বল্যমান চিত্র পাওয়া যায় এবং তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার ও নির্যাতন-বরণের বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। মোটকথা, তিনি এমন একজন বিনয়ী স্পষ্টবাদী, সমর্পিত-চিত্ত ভক্ত ছিলেন, যাঁর জীবন-চরিত আলোচনা করলেও লাভবান হওয়া যায়— দুর্বল চিত্তে বল-সঞ্চয় হয়।
তাই আজ যখন হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে জাতীয় পুনর্গঠনের আয়োজন চলছে, তখন চরিত্র, সাধনা ও শুভবুদ্ধি দ্বারা যিনি নিজে ব্রাহ্ম হ’য়েও মুসলিম ধর্মের আলোচনায় বিশেষ কীর্তি রেখে গেছেন, সেই বিরাট কর্মী মৌলবী গিরীশচন্দ্র সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা বিশেষ সময়োপযোগী হবে। এতে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিমের বর্তমান প্রশংসনীয় সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হতে পারে।’ (ই.ফা.বা. প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল, ১৯৮০)
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮) তাঁর ‘বাতায়ন’ গ্রন্থে লিখেছেন—
‘রাজসিংহ, পলাশীর যুদ্ধ প্রভৃতি বই পড়ার পর গিরীশ সেনের তাপস-মালা পড়ে মুগ্ধ চিত্তে ভাবলাম, তাহলে আমাদের ভাল জিনিসের কদর করার লোকও অন্য সমাজে আছে। এই উদার ধার্মিক বিদ্বানের প্রভাব নিঃসন্দেহ রকমে আমার উপর পড়ে ছিল। পরে তাঁর কুরআনের বঙ্গানুবাদ পড়ি। বাংলা ভাষায় তিনিই সকলের আগে ঐ অনুবাদ করেন। ধর্ম জিজ্ঞাসা ছিল তাঁর অন্তরের অন্তরতম আকাঙ্ক্ষা। সেই পরম জিজ্ঞাসার মহান তাকীদে তিনি একান্ত যত্নে, একান্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ইছলাম সম্বন্ধে অধ্যয়ন ও আলোচনা করেন।
কুরআন শরীফ ছাড়া তিনি মেশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ (৪র্থ খণ্ড) হযরত মুহম্মদ (দঃ), হযরত ইব্রাহীম, হযরত মুছা, হযরত দাউদ— এঁদের জীবন-চরিত, দেওয়ান হাফিজের বঙ্গানুবাদ, চারজন ধর্মনেতা প্রভৃতি পঁচিশখানা বই রচনা করেন। আজ পর্যন্ত বাংলার কোন মুছলিম লেখকও অতগুলি বিষয়ে অতগুলি বই লিখেছেন বলে আমার জানা নাই। ঢাকা জিলায় পাঁচদোনা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তিনি বাংলা, সংস্কৃত, আরবী ও ফারসীতে মস্ত পণ্ডিত ছিলেন।’ (পৃ. ২৮০, বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, জুলাই, ১৯৬৭)
উনবিংশ শতকের শেষ দিকে মুসলিম পুনর্জাগরণে যে ক’জন মনীষী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন (১৮৭০-১৯৩৭) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সেকালের খ্রিস্টান মিশনারীদের সংস্পর্শে এসে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে, অবিভক্ত বাংলা তথা ব্রিটিশ ভারতের একজন অবিসংবাদিত সিংহপুরুষ, ইসলাম প্রচারক ও তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক মুনশী মেহেরুল্লাহর (১৮৬১-১৯০৭) সঙ্গে ধর্ম সংক্রান্ত বাদানুবাদে লিপ্ত হয়ে আবার তিনি ইসলাম ধর্মের আশ্রয়ে ফিরে আসেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধর্ম প্রচার ও রক্ষা কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৩০৮ বঙ্গাব্দ, ‘ইসলাম প্রচারক’ পত্রিকার কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায়, শেখ জমিরুদ্দীন ‘শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী’ নামে পরিচিতিমূলক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনী আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন—
‘ইসলাম প্রচারকের’ পাঠকবর্গ মনে করিতে পারেন যে, ইসলামী কাগজে ব্রাহ্মের জীবনী কেন? বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের ইতিহাসের সহিত গিরিশবাবুর জীবনীর বিশেষ সম্বন্ধ আছে বলিয়াই, আজ ইসলাম প্রচারকে তাঁহার জীবনীর প্রচার হইল। বঙ্গদেশে খ্রিষ্টান মিশনারীরা অনেকদিন হইতে তাঁহাদিগের ধর্ম্মপ্রচার করিয়া আসিতেছিলেন ও কত শত মুসলমান যুবককে খৃষ্টানীর দিকে টানিতেছিলেন; কিন্তু যেদিন বঙ্গীয় মুসলমান যুবক “গিরিশবাবুর বঙ্গানুবাদিত কোরাণ শরিফ” ও “হজরতের জীবনী” হস্তে পাইয়াছেন, সেইদিন হইতেই তাঁহার স্বধর্ম্মের দিকে টান পড়িয়াছে। আর খৃষ্টান, হিন্দু ও ব্রাহ্ম ইসলামের মাহাত্ম্য বুঝিতে পারিয়াছেন।’ (পৃ. ১৮৭)
ধ্বনিবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) এবং খ্যাতনামা সাহিত্যিক, কবি ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান (১৯২০-২০০২) “বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে লিখেছেন—
‘ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে নববিধানের প্রবর্তনকারী ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন তাঁর কয়েকজন অনুবর্তীকে বিভিন্ন আলোচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র সেন এবং গৌরগোবিন্দ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। গিরিশচন্দ্র ইসলামের সাধনা ও সংস্কৃতির আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ঢাকা জেলার পাঁচদোনা গ্রামে ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন এবং পরিণত বয়সে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান। গিরিশচন্দ্রই সর্বপ্রথম কোরআন শরীফের সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ (১৮৮১-৮৬) এবং মিশকাত শরীফের প্রায় অর্ধাংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন।’ (পৃ. ১১০)
লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭) তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’-তে গিরিশচন্দ্র সেন সম্পর্কে লিখেছেন—
‘১৮৮১-৮৬ সালে কোরান-শরীফের সম্পূর্ণ অনুবাদ কার্য সম্পন্ন করেন। ইহাই প্রথম কোরান-শরীফের পূর্ণ বঙ্গানুবাদ। এই অনুবাদে বিখ্যাত তফসীর গ্রন্থসমূহ হইতে প্রভূত সাহায্য গ্রহণ করেন এবং টীকা-টিপ্পনী রচনা করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত বহু গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন মূল আরবী ও ফার্সি ভাষা হইতে। তাঁহার ‘হাদিস’ গ্রন্থখানাও বিখ্যাত। ইহা ‘মেশকাতুল মসাবিহ’ নামক বিখ্যাত আরবী হাদিস গ্রন্থের সংকলন। তিনি সর্বপ্রথম মেশকাতের পূর্ণ বাংলা অনুবাদ রচনা ও প্রকাশ করেন।’ (পৃ. ৪৩৩, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল, ২০০৪)
প্রাবন্ধিক, ছন্দবিশারদ ও কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) ‘কুরআন মজীদের বাংলা অনুবাদ’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন—
‘গিরীশ বাবু তাঁর এই অনুবাদ কার্য শুরু করেন ১৮৮১ সালে এবং সমাপ্ত করেন ১৮৮৬ সালে। প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ কুরআনের তরজমাকরণ, মুদ্রণ, প্রকাশনা— সবকিছুই সমাপ্ত হয়ে যায়।’ (ইসলামী একাডেমী পত্রিকা, এপ্রিল-জুন সংখ্যা, ১৯৬১)
গিরিশচন্দ্র সেন মাসিক ‘মহিলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রায় ১২ বছর সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদনায় এটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩০২ বঙ্গাব্দে। মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) প্রথম দিককার অনেক লেখা এই ‘মহিলা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
বেগম রোকেয়ার ভাই হাফেজ খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের-এর পৌত্রী অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার একজন উত্তরসূরি বিশিষ্ট লেখিকা ও শিক্ষাবিদ ‘মাজেদা সাবের’ তাঁর “ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়ী” গ্রন্থে লিখেছেন—
‘রোকেয়ার দ্বিতীয় রচনা— “অলঙ্কার না Badge of Slaver” ১৩১০ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে তিন কিস্তিতে ‘মহিলা’য় প্রকাশিত হয়। “অলঙ্কার না Badge of Slaver” ছাপা হবার পরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে গিরিশচন্দ্র তাকে সমাজের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।’
তিনি আরো লিখেছেন—
‘মহিলা পত্রিকা সম্বন্ধে রোকেয়া মন্তব্য করেছেন, আমারও মনে হয় ‘মহিলা’ যেন আমাদেরই কাগজ।’ (পৃ. ১১১)
বেগম রোকেয়ার সাথে গিরিশচন্দ্র সেনের পত্র যোগাযোগ ছিল। বেগম রোকেয়ার প্রতি গিরিশচন্দ্র সেনের মমত্ববোধ কত গভীর ছিল তা তাঁর “আত্ম-জীবন”-এর এই লেখা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়—
‘মোসলমানদের প্রতিভাশালিনী বিদূষী কন্যা মতিচূর পুস্তকের রচয়িত্রী শ্রীমতী আর. এস. হোসেন মৎকর্ত্তৃক অনুবাদিত ধর্ম্মসাধন নীতিপুস্তকের সমালোচনায় আমাকে “মোসলমান ব্রাহ্ম” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি আকৃতি প্রকৃতি ভোজ্য পরিচ্ছেদ আচার ব্যবহারাদি দেখিয়া আমাকে মোসলমান ব্রাহ্ম বলেন নাই, আমি মোসলমান জাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করিয়া থাকি তজ্জন্য সেরূপ বলিয়াছেন, ইহা নিশ্চিত।
তাঁহার সঙ্গে আমার মাতৃ-পুত্র সম্বন্ধ স্থাপিত। সেই মনস্বিনী মহিলা উক্ত ঘনিষ্ঠতার পরিচয় নিজেই প্রদান করিয়া থাকেন। তিনি আমাকে পত্রাদি লিখিতে পত্রে নিজের নাম না লিখিয়া নামের পরিবর্ত্তে “মা” বা “আপনার স্নেহের মা” বলিয়া স্বাক্ষর করিয়া থাকেন। কিন্তু মাতা অপেক্ষা পুত্রের বয়ঃক্রম দ্বিগুণেরও অধিক। মাতার ২৬/২৭ বৎসর বয়ঃক্রম, পুত্রের ৭১/৭২ বৎসর বয়স।’ (পৃ. ৫০-৫১)
শেষ করবো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম চিন্তক, সাংবাদিকতার পথিকৃত, রাজনীতিবিদ, ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞ ও সমাজ সংস্কারক ঢাকার প্রথম দৈনিক পত্রিকা— দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ‘মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র বক্তব্য দিয়ে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মৃত্যুর অনেক পরে ২৪ নভেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে যখন ‘নববিধান পাবলিকেশন কমিটী’র উদ্যোগে গিরিশচন্দ্রের অনূদিত কোরআনের ৪র্থ সংস্করণ বের হয় তখন সেটির ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি। মওলানা আকরম খাঁ লিখেছেন—
‘তিন কোটি মোসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা, তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশের কোন মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবী-পার্শী ভাষায় সুপণ্ডিত মোসলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যথেষ্ট অধিকার ছিল, তাঁহাদের রচিত বা অনুবাদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরু কর্তব্যভার বহন করার জন্য সুদৃঢ় সঙ্কল্প নিয়া সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরীশচন্দ্র সেন— বিধান-আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে। গিরীশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
লেখক : গবেষক
মন্তব্য করুন