দুর্গাদেবীর আগমনীই ‘মহালয়া’
মহালয়া মানে দুর্গাপূজার দিন গোনা, মহালয়ার ৬ দিন পর মহাসপ্তমি। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আসল দুর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে শারদীয় পূজা ও দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়।
এমনটিও বলা হয়ে থাকে যে, পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি - তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে 'মহালয়ার' বার্তা বহন করে আনে। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া। মহালয়ার মধ্য দিয়েই দেবীর মর্ত্যে আগমনের সূচনা ঘটে। বিশেষ পূজা আর মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খের ধ্বনি ও চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে আবাহন করা হয়। মহালয়ের দিন অনেকেই গঙ্গাস্নান সেরে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করে তর্পণ করেন।
‘মহালয়া’ কথাটির অর্থ মহৎ আলয়। একটি মত বলে, এর অর্থ প্রেতের আলয়। শাস্ত্র মতে এ দিন প্রয়াত আত্মারা মর্তে আসেন বলে মনে করা হয়। মহা+আলয় জুড়ে এই শব্দ। সন্ধির নিয়ম মেনে শব্দটি সে ক্ষেত্রে হওয়ার কথা ছিল ‘মহালয়’। তা হলে ‘মহালয়া’ কেন? এর কোনও ব্যকরণগত ব্যাখ্যা নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্ধকার পেরিয়ে দেবীপক্ষের শুভ সূচনা হয় বলে শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গ করে ‘মহালয়া’ বলা হয়।
এই দিনটিকে ঘিরে নানা পৌরাণিক কাহিনি থাকলেও মহাভারতের সঙ্গে মহালয়ার নিবিড় যোগ রয়েছে। মহাকাব্য অনুসারে, মহাভারতের যুদ্ধে মৃত্যুর পরে স্বর্গে কর্ণকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও ধনরত্ন দেওয়া হয়েছিল। কর্ণ তখন দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রশ্ন করেন যে, কেন তাকে খাদ্যের বদলে এ সব দেওয়া হয়েছে। ইন্দ্র জানান, কর্ণ চিরকাল ধনরত্ন ও স্বর্ণ দান করে এসেছেন, কিন্তু পূর্বপুরুষদের কখনও জল, খাদ্য দেননি। তাই তাকেও খাদ্যের বদলে এ সবই দেওয়া হয়েছে।
কর্ণ জানান, তিনি তার পূর্বপুরুষদের বিষয়ে অবগত ছিলেন না। সে কারণেই তাকে আবার ১৫ দিনের জন্য মর্ত্যে পাঠানো হয়। ফিরে এসে কর্ণ পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেন। সেই থেকেই নাকি এই বিশেষ দিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জল দেওয়ার এই রীতি।
মহালয়ার তিথিতে যা করা হয়: এই তিথিতে ব্রাহ্মণ ভোজন করালে, তাতে বিশেষ ফল মেলে বলে মনে করা হয়। পাঁচ থেকে সাতজন ব্রাহ্মণকে এই তিথিতে ভোজন করানোর রীতি রয়েছে। পাশাপাশি, দুঃস্থ শিশুদের বস্ত্র বিতরণ করলে বা দুঃস্থ শিশুদের খাবার খাওয়ালে অথবা ফলদান করলেও সুফল মিলতে পারে। এর সঙ্গে, এই তিথিতে পশুপাখিকে খাওয়ালে তার শুভ ফল মেলে বলেই মনে করা হয়। এই বিশেষ তিথিতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে কাঁচা দুধ, কালো তিল, আতপ চাল, সাদা ফুল এবং গঙ্গাজল দিয়ে তর্পণ করাই বিধি। অনেকেই স্থানীয় জলাশয়ে বা গঙ্গায় সেই তর্পণ সারেন। এই তিথিতে নিরামিষ আহার গ্রহণ হিন্দুদের অন্যতম রীতি।
এই তিথিতে যা করা নিষেধ: এই তিথিতে চুল, দাঁড়ি কাটতে নেই। কাউকে কোনও কিছু ধার দিতে নেই। এই তিথিতে বাড়িতে কোনও মাঙ্গলিক কাজ করতে নেই। বাড়ি, গাড়ি বা নতুন কিছু কেনাকাটা করার জন্য এই তিথি শুভ নয়। এই তিথিতে বাড়িতে কোনও ভিখারি এলে তাকে খালি হাতে না ফেরানোই বিধি। এর পাশাপাশি, মহালয়ার দিন মদ্যপানও করতে নেই। এই তিথিতে মাটিতে গর্ত খুঁড়তে নেই বলেও প্রচলিত আছে।
মহালয়ার তর্পণবিধি: আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে পিতৃপক্ষ শুরু হয়। হিন্দুরা এরপর একপক্ষকাল অর্থাৎ ১৫ দিন বিদেহি আত্মাদের স্মরণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যার সমাপ্তি ঘটে মহালয়ায়। এই তিথিতে ভোরবেলা উঠে পুজোপাঠই রীতি। যারা তর্পণ করেন, তাদের ধুতি বা শুদ্ধ বস্ত্র পরতে হয়। সাধারণত গঙ্গা অথবা নদীতীর বা জলাশয়েই সারতে হয় তর্পণ। খালিপেটে এই সব আচার পালন করতে হয়। এই বিশেষ তিথি উপলক্ষে পিতৃপুরুষের ছবিতে বা মূর্তিতে মাল্যদানের রীতি আছে। তাদের ছবি বা মূর্তির সামনে পছন্দের খাবার সাজিয়ে দেওয়াই রীতি।
সূত্র: অনলাইন
আরটিভি/এফআই
মন্তব্য করুন