মিশরের রমজান রজনী ও ইফতার

আফছার হোসাইন, মিশর প্রতিনিধি

মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫ , ১২:১৫ পিএম


মিশরের রমজান রজনী ও ইফতার

ফেরাউনদের দেশ যেমন মিশর ঠিক তেমনি অসংখ্য নবী-রাসূল, সাহাবা, অলি-আউলিয়াদের দেশও মিশর। পবিত্র কোরআনে 'মাসর' (মিশর) শব্দটি পাঁচবার উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা অনেক নেয়ামত-অনুকম্পায় মিশরীয়দের সিক্ত করেছেন। নীল নদের পানির বরকতে মিশরের মাটি থাকে সব সময় উর্বর। তাই মিশরকে নীল নদীর দান বলা হয়। হাজারো বছরের প্রাচীন কৃষ্টি সভ্যতাসমৃদ্ধ দেশটিতে রোজা শুরু হয় বেশ ধুমধাম করেই। এদেশে প্রতিটি বাড়ি, রাস্তা, দোকানে ফানুস জ্বালানো রমজানের সংস্কৃতি।

বিজ্ঞাপন

প্রথম রোজার দিন থেকেই দুপুরের পরপরই দেশটির বিভিন্ন শহরের অলিগলিতে সাজানো হয় ইফতারির জন্য মায়েদাতুর রাহমান বা রহমতের টেবিল। কোথাও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, কোথাও সেবামূলক সংস্থার অধীনে রাস্তায় সামিয়ানা টানিয়ে মায়েদাতুর রাহমান নামক ইফতারির আয়োজন করা হয়।

ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মুসলিম-খ্রিস্টান প্রত্যেকেই অংশ নেন এই ইফতার টেবিলে। ফেরাউনের স্মৃতি বিজড়িত দেশ মিশরের সব কয়টি শহর ও জাতীয় টেলিভিশনের মাধ্যমে কামানের গোলার শব্দে শুরু করা হয় ইফতার। শত শত বছর ধরে চলে আসা কামানের শব্দ শুনে ইফতার করা তাদের একটি সামাজিক প্রচলন। ৮৫৯ হিজরিতে ইখশিদি আমল থেকে চালু হয় এই নিয়ম।

বিজ্ঞাপন

কথিত আছে, কামানের গোলা ছোড়ার মাধ্যমে ইফতারের সময় ঘোষণার ঐহিত্য ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়। যখন ঘড়ি বা অন্যান্য প্রযুক্তি ছিল না, তখন মানুষকে ইফতারের সময়ের জানান দেওয়া ছিল একমাত্র পন্থা।

সাধারণত খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙা হলেও  কোষাফ ও তাজা ফলের নির্যাস পান করার মাধ্যমে ইফতার শুরু করেন মিশরীয়রা। প্রধান ইফতার পদে থাকে মা’হসী (আংগুর পাতা, বেগুন, জুকিনি, বাঁধা কপির ভেতরে ভাত) মলোকাইয়া (পাট শাকের সোপ), বামিয় মা’আ লাহমা (মাংস ও ঢেঁড়শ ভুনা), ফেরাখ মা’হামারা (মুরগির রোস্ট) এইস বেলাদী (মিশরীয় আটার রুটি), তাজা ফল ও পুদিনা পাতার চা ইত্যাদি।

ইফতারের ঘণ্টা খানেক পর থেকে সেহরি পর্যন্ত পুরো সময়টাতে সব জায়গায় থাকে ইবাদত করার মনোরম পরিবেশ।মাগরিবের কিছুক্ষণ পর থেকেই নারী-পুরুষ ছুটে যায় তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করতে। এদেশে প্রতিটি মসজিদে মহিলাদের জন্য নামাজ আদায়ের আলাদা কক্ষ আছে। শাফি মাজহাবের দেশটির সকল মসজিদেই ১ থেকে ২ ঘণ্টা সময় নিয়ে তারাবিহ পড়া হয় ৮ রাকাত। প্রতিরাতেই ইমামরা তারাবিতে পবিত্র কোরআন থেকে এক বা একাধিক পারা তেলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবিহর নামাজ আদায় করেন। কোনো কোনো মসজিদ তিন-চার পারাও তেলাওয়াত করা হয়। বিভিন্ন কেরাতে (তেলাওয়াত-শৈলী) ইমামরা নামাজ পড়ান। তারাবির নামাজের মধ্যভাগে থাকে সংক্ষিপ্ত বিরতি ও আলোচনা। এ সময় প্রতিটি মসজিদেই বাচ্চারা তাদের বাড়ি থেকে (মায়েদের দেওয়া) আনা মিষ্টি, খেজুর ফলের জুস ও ঠান্ডা পানি দিয়ে মুসল্লিদের আপ্যায়ন করতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

তারাবি শেষে মুসল্লিরা তাদের নিজ নিজ ঘরে ফেরেন। ১৫তম রোজার পর থেকে তারাবির দুই-তিন ঘণ্টা বিশ্রামের পর তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের জন্য মুসল্লিরা আবার ফিরে যান মসজিদে। তারা জামাতবদ্ধ হয়ে তাহাজ্জুদ আদায় করেন এক বা দুই খতম কোরআন পড়ার মাধ্যমে। পবিত্র রমজানে আরেকটি বিষয় যেটি মিশরে বেশি দৃশ্যমান হয়, তা হলো পবিত্র কোরআনের প্রতি তাদের যত্ন ও ভালোবাসা। চাকরি ক্ষেত্র, যানবাহন সর্বত্রই দেখা যায় মোবাইল অথবা পকেট সাইজ কোরআন হাতে নিয়ে পড়তে। বলা হয়, পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে হিজাজে। আর এ কোরআন উত্তমরূপে তেলাওয়াত হয়েছে মিশরে। পুরো রমজানজুড়ে সেখানে থাকে কোরআন চর্চার পরিবেশ। সব জায়গা থেকে শোনা যায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ।

বিশ্বের বড় বড় নন্দিত ক্বারিদের জন্ম হয়েছে মিশরে। ক্বারি আব্দুল বাসেত আব্দুস সামাদ, মাহমুদ খলিল আল-হুসারি, আস-সিদ্দিক আল-মিনশাওভি সহ আরও অনেকেরই এখানে জন্ম এদেশে। রমজান মাসে সব জায়গা থেকে ভেসে আসে সুমিষ্ট কণ্ঠের তেলাওয়াত। অভ্যাসগতভাবেই মিশরীয়রা তেলাওয়াত করতে ও শুনতে পছন্দ করে।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission