ঢাকাসোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

২০২০ সালের আঁতকে ওঠা ৪ হত্যাকাণ্ড

কাজী ফয়সাল

সোমবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২০ , ০৬:৫৭ পিএম


loading/img
মেজর সিনহা, এএসপি আনিসুল, মাথায় টুপি পরা শহিদুন্নবী জুয়েল এবং যুবক রায়হান আহমেদ ফাইল ছবি

আর একটিও হত্যা নয়, রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যেক নাগরিক পেতে চায় এমনই অভয়। ২০২০ সাল প্রায় শেষ। আর মাত্র কয়েকদিন পর শুরু হবে নতুন বছর ২০২১। কোনও অঘটনই মানুষের প্রত্যাশিত নয়। তবুও দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলছে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষ হত্যা যেনো দুধ ভাতে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ভক্ষকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে খোদ রক্ষককেই! ইচ্ছে হলেই গুজব রটিয়ে, মিথ্যা ট্যাগ দিয়ে জনসম্মুখে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। এমনসব ঘটনা বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে, তা দেখে স্বাভাবিক থাকা অসম্ভব হয়ে যায় অনেকেরই। এমন এক একটি হত্যাকাণ্ড দেশের বিবেকবান প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়ে দিয়েছে খোদ রাষ্ট্রকেই।

অতীতের হত্যাকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে দোষীদের যথাযথ বিচার নিশ্চিতের দাবি সকলের। আসন্ন নতুন বছর ২০২১ সালে সকলের প্রত্যাশা, যেন ভালো কাটে আগামীর বছর। প্রতিটি নাগরিকই রাষ্ট্রের কাছে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের যথাযথ ব্যবস্থা চায়।

বিজ্ঞাপন

চলতি বছরে আলোচিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় উঠে। নতুন বছর ২০২১ শুরুর আগে দেখে নেওয়া যাক ২০২০ সালে দেশের আলোচিত ৪টি হত্যাকাণ্ড ও এসবের সর্বশেষ অবস্থা। 

আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- কক্সবাজারে পুলিশ চেকপোস্টে মেজর সিনহা হত্যা, রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে কর্মীদের মারধরে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম হত্যা এবং ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে সিলেটে মেট্রোপলিটনের বন্দরবাজার ফাঁড়ির মধ্যে রায়হান আহমেদ নামের এক যুবককে হত্যা। এছাড়াও লালমনিরহাটে মসজিদের ভেতরে কোরআন শরীফ অবমাননার গুজব রটিয়ে জুয়েল নামের এক মুসল্লিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

মেজর সিনহা হত্যা মামলার সর্বশেষ তথ্য:

বিজ্ঞাপন

চলতি বছরের গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে বহনকারী গাড়ি দাঁড় করানো হয়। তিনি গাড়ি থেকে বের হলে তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। জীবন নিরাপত্তার রক্ষক হয়ে উল্টো জীবন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় অসংখ্য প্রশ্নের মুখে পড়ে গোটা পুলিশ বাহিনী।

এই হত্যার ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার কক্সবাজারের আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় সিনহার সঙ্গে কক্সবাজারে ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত এবং তাহসিন রিফাত নূর। পরে পুলিশ তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে। পুলিশ বাদি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে।

এরপর আজ সোমবার (২১ ডিসেম্বর) এই হত্যার মামলার চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। একই সাথে এই মামলার পলাতক আসামি সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট ঘটনায় দায়ের করা ২ টি মামলা থেকে সিনহার সহযোগী সিফাতকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আজ বেলা সাড়ে ১১টায় জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম (কক্সবাজার সদর-৪) তামান্না ফারাহ’র আদালত এ আদেশ দেন।

এর আগে, গত ১৩ ডিসেম্বর একই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাববের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। মামলায় যে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয় তার মধ্যে  ১৪ জন গ্রেপ্তার আছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল হত্যা:

মানসিক সমস্যার চিকিৎসায় সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে ৯ নভেম্বর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে নিয়ে যান স্বজনরা। এরপর সেখান থেকে তাকে আদাবরের মাইন্ড এইড নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের মারধরের শিকার হন। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ হত্যাকাণ্ডের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হতে পারে। এ ঘটনায় চার্জশিটে মাইন্ড এইড হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
মাইন্ড এইড হাসপাতালের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে আনিসুলকে মারধরের ঘটনা ধরা পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ফুটেজ ভাইরাল হয়। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আনিসুলকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পায় পুলিশ।

এ ঘটনায় আনিসুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে গত ১০ নভেম্বর মাইন্ড এইডের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার আসামিদের মধ্যে ১২ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে হাসপাতালটির অন্যতম পরিচালক ডা. নিয়াজ মোর্শেদ রাজধানীর একটি হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন আছেন। বাকি ১১ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের মধ্যে ৬ জন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আনিসুল হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনকেও গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাকেও এ মামলায় অভিযুক্ত দেখানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক অপারেশন ফারুক হোসেন মোল্লা আরটিভি নিউজকে জানান, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য, অন্যসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই চার্জশিট দেয়া হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চার্জশিট দেয়া হতে পারে। তিনি জানান, ঘটনার সঙ্গে আসামিদের জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই চার্জশিট দেয়া হবে।

জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায়- আনিসুলকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মাইন্ড এইডের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অ্যাগ্রেসিভ ম্যানেজমেন্ট রুমে জোর করে তাকে ঢুকানো হয়। রুমে নিয়ে তাকে উপুড় করে শুইয়ে দুই হাত পিঠ মোড়া করে বাঁধা হয়। এ সময় ঘাড়, মাথা, পিঠ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। আনিসুলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

তদন্ত সূত্র জানায়, আনিসুল হত্যা মামলার চার্জশিটে মাইন্ড এইডের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মাসুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম পলাশ, মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন ময়না এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. আবদুল্লাহ আল মামুনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন, সাজ্জাদ আমিন ও সাখাওয়াত পলাতক। ডা. নিয়াজ মুর্শেদ পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন। অন্যরা কারাগারে রয়েছে।

পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা:

গত ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট মেট্রোপলিটনের আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে ছিনতাইকারী ট্যাগ দিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।

এ ঘটনায় নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে পরের দিন ১২ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এর আগে রায়হান হত্যাকাণ্ডে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপরে সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র এবং এসআই আব্দুল বাতেন ভুঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের সদর পুলিশের সদর দপ্তরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সদর দপ্তরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

‘কোরআন শরীফ’ অবমাননার গুজব রটিয়ে পুড়িয়ে হত্যা:

গত ২৯ অক্টোবর কোরআন শরীফ ‘অবমাননার’ গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে আবু ইউনুস মো. শহিদুন্নবী জুয়েল (৪৫) নামের এক মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের ওপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ৩ টি মামলায় এজাহার নামীয় ১১৪ আসামি এবং অজ্ঞাত শত শত আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে জুয়েলকে প্রথম মারধরকারী ও হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন আলী, দুই নম্বর আসামি খাদেম জোবায়েদ আলী ওরফে জুবেদ আলী এবং মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দরের একটি মসজিদে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনার দিন ওই মসজিদে আছরের নামাজের পর জুয়েল নামের ব্যক্তি ধর্মের অবমাননা করেছেন, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা এবং তার রক্তাক্ত মরদেহ আগুন দিয়ে পোড়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

কেএফ/এমকে 

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |