একের পর এক ১১ শিশু হত্যার নেপথ্যে পরকীয়ার ১১ ঘটনা
অসামাজিক এবং অনৈতিক ভাইরাস ‘পরকীয়ার’ থাবায় কেবল সুখের সংসারই নষ্ট হচ্ছে না, নৃশংসভাবে এর বলি হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। অথচ, দাম্পত্য জীবনে চাহিদার সঙ্কটে সঙ্গী পছন্দ না হলে সামাজিকভাবে, আইনগতভাবে এমনকি ধর্মীয়ভাবে ডিভোর্সের মাধ্যমে স্বামী কিংবা স্ত্রী পরিবর্তন করে সুন্দর জীবন যাপন করার বৈধতা রয়েছে। মনো বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন সামাজিক অদক্ষতা এবং যথাযথ প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে এক শ্রেণির পুরুষ ও নারীরা পরকীয়ার মাধ্যমে নোংরামিতে লিপ্ত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়া এবং এটি বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যা এই প্রতিবেদনের শেষ দিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় সদ্য ঘটে যাওয়া গুলি করে ৩ জনকে হত্যার প্রাথমিক তদন্তে এর নেপথ্যে ‘পরকীয়াকেই’ টার্গেট করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। যে ঘটনাটি ঘটেছে খোদ একজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থারই সদস্যের হাতে। তার নাম সৌমেন, তিনি খুলনায় কর্মরত একজন পুলিশ সদস্য।
সার্বিক পরিস্থিতিতে পরকীয়াকে কেন্দ্র করে শিশু হত্যার নেপথ্যে মায়েদের সরাসরি জড়িত থাকা অথবা সম্পৃক্ততার তথ্য বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান চালিয়ে আরটিভি নিউজ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেছে।
(১) পরকীয়া: প্রকাশ্যে ৩ প্রাণ নিলো এএসআই, চালিয়েছে ১১ গুলি
ঘটনাটি রোববার (১৩ জুন), ২০২১ এর। কুষ্টিয়ায় পরকীয়ার কারণে খুন হন গৃহবধূ আসমা খাতুন (২৫), তার শিশু ছেলে রবিন এবং আসমার অনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গী শাকিল। তাদের ৩ জনকেই পিস্তল দিয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেন আসমার সাবেক স্বামী পুলিশের এএসআই সৌমেন।
-
আরও পড়ুন... যেভাবে দুই অ্যাপে শতশত কোটি টাকা পাচার
পুলিশ বলছে, হত্যার শিকার শিশু রবিন আসমার আগের সংসারের সন্তান, সৌমেনের নয়। আর শাকিল আসমা খাতুনের বয়ফ্রেন্ড। এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে মোট ১১টি গুলি চালায় ওই এএসআই সৌমেন।
জানা গেছে, এএসআই সৌমেন কুষ্টিয়ার হালশা ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের আসমার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর আসমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরে সোমেন (বর্তমান পোস্টিং) খুলনার ফুলতলায় বদলী হলে আসমা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আসমা তার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড বিকাশ কর্মী সাকিলের সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত হলে ক্ষেপে যান সৌমেন। এই বিরোধে সৌমেন ক্ষিপ্ত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
(২) শিশু আরাফকে মা নিজেই হত্যা করেন
ঘটনাটি ৩ জুন, ২০২১ এর। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দেওগাঁও চেড়াডাঙ্গী গ্রামে পরকীয়ায় বিকারগ্রস্ত মা জান্নাতা আক্তার তারই সন্তান ৬ বছর বয়সী আমির হামজা আরাফকে বালিশ চাপা দিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন! এ ঘটনার দায় স্বীকার করে মা জান্নাতা আক্তার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
জান্নাত জানান, তার স্বামী খলিলুর রহমানের সাথে ঢাকায় থাকার সময় একই ভবনের ফ্ল্যাটে বসবাসকারী ইমরান নামের এক অবিবাহিত ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের সুবাদে উভয়ের মধ্যে ভালোবাসা এবং গোপন শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এর মধ্যে গত ২ মাস আগে রাষ্ট্রীয় ‘কঠোর বিধিনিষেধের’ আর্থিক সঙ্কটে পড়ে স্ত্রী ও সন্তানদের ঠাকুরগাঁওয়ের দেওগাঁও চেড়াডাঙ্গী গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যান খলিলুর রহমান।
এদিকে, ইমরান জান্নাত আক্তারকে বিয়ে করার জন্য মোবাইল ফোনে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। দুই সন্তান ও স্বামীকে ছেড়ে ইমরানকে বিয়ে করা নিয়ে জান্নাত মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে গত ৩ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আরাফ তার নানার ঘরে দুষ্টামি করছিল, যা মা জান্নাত আক্তার সহ্য করতে পারেনি। একপর্যায়ে তার ছেলে আরাফকে বিছানার উপর থেকে ফেলে দিয়ে মাথা চেপে ধরে গলার দুই পাশ থেকে গামছা পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
-
আরও পড়ুন... 'এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা না হলে বিকল্প চিন্তা'
(৩) বাবা প্রবাসে, স্কুলছাত্র পারভেজ হত্যায় মা ও তার প্রেমিক গ্রেপ্তার
ঘটনাটি ১৫ অক্টোবর, ২০২০ এর। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র পারভেজ মোশাররফকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ঘটে। যে ঘটনায় শিশুটির মা রোজিনা ও প্রেমিক এমদাদসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই ঘটনায় নিহতের ২টি মোবাইলসহ আরেক আসামি রবিউলকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। নিহতের মায়ের পরকীয়ার কারণেই ভাড়াটে খুনি দিয়ে পারভেজকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে র্যাব। তবে পিবিআই বলছে, মায়ের সহায়তায় রবিউল একাই হত্যা করেছে পারভেজকে। কারণ একই ‘পরকীয়া’।
র্যাব-১৪ এর উপ-অধিনায়ক মেজর ফজলে রাব্বি জানান, মা ও তার প্রেমিক এমদাদের অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় প্রবাসী স্বামী জেনে যেতে পারে এমন আশংকায় পারভেজকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এদিকে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস জানান, ‘একাধিক অনৈতিক সম্পর্ক জেনে যাওয়ায় টাকার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিবেশী রবিউলকে দিয়ে পারভেজকে হত্যা করায় মা। গ্রেপ্তারকৃত রবিউল ময়মনসিংহের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে।
(৪) বাবা প্রবাসে, বিছানায় শিশু ও সিগারেটের প্যাকেট, মা লাপাত্তা
ঘটনাটি ২৭ মার্চ, ২০২০ এর। নওগাঁয় পরকীয়ার জেরে সুমাইয়া আক্তার নামে ৭ বছরের শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগ উঠে তার মা তামান্না বেগমের বিরুদ্ধে। সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর সরদারপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সুমাইয়া আক্তার ওই গ্রামের প্রবাসী সিরাজুল ইসলামের মেয়ে। ঘটনার পর শিশুটির মা প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিনের ন্যায় শুক্রবার রাতে মা তামান্না বেগম ও মেয়ে সুমাইয়া আক্তার রাতের খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়েন। শনিবার সকালে তারা ঘুম থেকে না ওঠায় সুমাইয়ার দাদি তাদের ডাকতে যান। ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়ার পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না মেলায় তিনি জোরে ধাক্কা দিলে দরজা খুলে যায়। এ সময় খাটের ওপর সুমাইয়াকে ঘুমানো অবস্থায় দেখা গেলেও তার মা তামান্না বেগমকে দেখা যায়নি। সুমাইয়াকে ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে তার গায়ে হাত দিলে কোনো নড়াচড়া না পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন দাদি।
এ সময় স্থানীয়রা এসে দেখেন, শিশু সুমাইয়ার নিথর দেহ খাটের ওপর পড়ে আছে এবং তার মা বাড়িতে বা এলাকায় নেই। ঘরের মধ্যে খাটের ওপর অগোছালো বিছানার চাদর, সিগারেটের প্যাকেট।
সুমাইয়ার বাবা দীর্ঘদিন থেকে প্রবাসে রয়েছেন। আর এ সুযোগে তামান্না বেগম গোপনে মোবাইলে অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলতেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
(৫) তাহের ও বিবি ফাতেমাকে গলায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়
ঘটনাটি ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ এর। চট্টগ্রামে বিবি ফাতেমা নামের ৪ বছরের এক শিশু মা বিবি হাছিনার পরকীয়া প্রেমের বলি হয়। এই শিশুকন্যার সঙ্গে তার বাবা আবু তাহেরকেও (৩২) গলায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছিলো। পরে নিহতের ভাই নুরুল আমিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করলে তাহেরের স্ত্রী বিবি হাছিনাসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পরকীয়ার ঘটনা জানতে পারে পুলিশ।
ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারের পর শুরুতে বিবি হাছিনা দাবি করেছিলেন, তিনি অন্যের বাসায় কাজ করতে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে বাসায় ফিরে মেয়ে ও স্বামীর মরদেহ দেখতে পান। কিন্তু তার এই তথ্য অসংলগ্ন মনে হয়। পরিস্থিতিতে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে মা বিবি হাছিনা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে থাকেন। এর এক পর্যায়ে তিনি জানান, এক লোকের সঙ্গে তার (হাছিনার) পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। অনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্য দেখে ফেলার কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
(৬) তিন সন্তানকে হত্যাচেষ্টা মা, শেষে এক সন্তানের মৃত্যু নিশ্চিত
ঘটনাটি ১৮ অক্টোবর, ২০১৯ এর। হবিগঞ্জ পরকীয়া প্রেমের টানে ৩ শিশু সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা করেন মা ফাহিমা খাতুন ও তার প্রেমিক আক্তার। ভাগ্যক্রমে ২ সন্তান বেঁচে গেলেও মৃত্যুর কাছে হার মানে ছোট মেয়ে ৬ বছর বয়সী সাথী আক্তার। ঘটনার ১ বছর পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে এ হত্যার রহস্য।
পুলিশ জানায়, এই হত্যার বিষয়ে ফাহিমা খাতুন (২৮) হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানান, আদালতকে ফাহিমা জানিয়েছেন তার স্বামী অভাব অনটনের কারণে জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ওলিপুরে প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি নেন। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পাশের বাড়ির বিত্তশালী আক্তারের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে ফাহিমার। তাদের এ সম্পর্ককে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে তারা বুঝতে পারেন ‘পথের কাটা’ ফাহিমার ৩ সন্তান। তাই আক্তার ও ফাহিমা মিলে ৩ সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর পরকীয়া প্রেমিক আক্তার বিষ কিনে ফাহিমাকে দেন। পরের দিন ১৮ অক্টোবর দুপুরে ফাহিমা জুসের সাথে বিষ মিশিয়ে ৩ শিশু সন্তানকে খাইয়ে দেন। বিষক্রিয়ায় তারা অসুস্থ হয়ে পরলে ওই দিন সন্ধ্যায় তাদেরকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিলে ছোট সন্তান সাথী আক্তার (০৬) মারা যায়।
অপর দুই শিশু সন্তান তোফাজ্জল ইসলাম (১০) ও রবিউল ইসলামকে (৭) দ্রুত সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে সৌভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যায়।
পরে ঘটনা রহস্য উদঘাটন হলে ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে ফাহিমাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার দায় স্বীকার করে একই বছরের ১ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ফাহিমা।
(৭) চাচি-ভাতিজার পরকীয়ার বলি শিশু মাহিমা
ঘটনাটি ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এর। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার সালামাবাদ ইউনিয়নের হাড়িডাঙ্গা গ্রামে চাচি-ভাতিজার পরকীয়া নিয়ে পারিবারিক কলহে মাহমুদা ইসলাম মাহিমা (২) নামে এক শিশুকে হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যার শিকার মাহিমা হাড়িডাঙ্গা গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী মাহমুদ থান্দারের মেয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল ১০টার দিকে মাহিমার মা তাসলিমা বেগমকে (৩০) তার চাচি শাশুড়ি রোজিনা বেগমসহ (৩৫) তাদের লোকজন বেদম মারধর করে।
এক পর্যায়ে রোজিনা বেগম ও তার ছেলে মিথাল থান্দারসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা শিশুকন্যা মাহিমাকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে তাসলিমা বেগমকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। পরে শিশু মাহিমাকে পুকুরে ভাসতে দেখেন প্রতিবেশীরা। এ ঘটনায় কালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বর থেকে রোজিনা বেগমকে আটক করে পুলিশ।
মাহিমার মা তাসলিমা বেগম অভিযোগ করেন, তার স্বামী মাহমুদ থান্দার প্রায় ১৪ বছর ধরে বিদেশে আছেন। দেশে আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে চাচি রোজিনা বেগমের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন।
ফলে বিদেশ থেকে চাচির (রোজিনা) নামেই টাকা পাঠান। পরকীয়ার কারণে তাসলিমাকে সহ্য করতে পারেন না স্বামী মাহমুদ থান্দার ও চাচি শাশুড়ি রোজিনা। প্রায়ই তাসলিমার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়েন রোজিনা বেগম। এরই জের ধরে রোববারও তাসলিমার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হন রোজিনা বেগম। মাহিমাকে কেড়ে নিয়ে ঘাড় মটকে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
(৮) মায়ের পরকীয়া জেনে ফেলায় স্কুল ছাত্রকে হত্যা
ঘটনাটি ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯ এর। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায় মায়ের পরকীয়া সম্পর্ক জেনে ফেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র নৃশংসভাবে খুন হয়। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য হত্যার বিষয়ে আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। নিহত ওই ছাত্রের নাম সিয়াম (১১)। তার বাবার নাম মো. শাহজাহান গাজী। তারা মজিদবাড়িয়া ইউনিয়নের সুলতানাবাদ গ্রামের বাসিন্দা।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ইউপি সদস্যের নাম সাইদুল ইসলাম ওরফে জামাল। তাকে মির্জাগঞ্জ থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে সিয়ামকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন সাইদুল।
এরপর সাইদুলকে মির্জাগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেওয়া হয়। আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আসিফ ১৬৪ ধারায় সাইদুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাইদুল জানিয়েছেন, প্রতিবেশী হওয়ায় সিয়ামদের বাড়িতে সাইদুলের দীর্ঘদিন আসা-যাওয়া ছিল। একপর্যায়ে শাহজাহানের স্ত্রীর সঙ্গে সাইদুলের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সাইদুলের সঙ্গে মাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে সিয়াম। এরপরই সিয়ামকে হত্যা করেন সাইদুল। এই হত্যাকাণ্ডে সাইদুলকে আরও ৬ জন সাহায্য করেছে বলেন জানায় পুলিশ।
(৯) বাবার পরকীয়ার বলি শিশু সন্তান
ঘটনাটি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ এর। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে পরকীয়ার জেরে আল-আমীন (৬) নামে এক শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে দুই নারীসহ ৩ জনকে আটক করে পুলিশ।
আটককৃতরা হলো- কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার হাত্রাপাড়া এলাকার আব্বাস আলীর ছেলে জয়নাল আবেদীন (১৯), জয়নালের মা নুরেছা বেগম (৪০) ও তার বোন নিশিতা আক্তার (২১)। আটককৃতরা তেলিরচালা এলাকায় ভাড়া থাকেন।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, জয়নাল আবেদীনের বোন নিশিতার সাথে আল-আমিনের বাবা জুয়েল হোসেন এর অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। জুয়েল নিশিতাকে বিয়ের প্রলোভন দেখালেও বিয়ে করেননি। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি জুয়েলের সাথে জয়নালের ঝগড়া হয়। এ ঘটনার জের ধরে জয়নাল মঙ্গলবার দুপুরে আল-আমীনকে ডেকে নিয়ে পাশের নির্জন স্থানে নিয়ে যায় এবং তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
পরে পুলিশ জয়নাল, তার মা এবং বোনকে আটক করে। জয়নালের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আল-আমীনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
(১০) পরকীয়ার বলি ১৪ মাসের শিশু
ঘটনাটি ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ এর। নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় স্ত্রীকে নির্যাতনের পর ১৪ মাস বয়সী কন্যা শিশু নুসরাত জাহান নুরীকে গলাটিপে হত্যা করে পাষণ্ড পিতা।
এলাকাবাসী জানান, উপজেলার মুছাপুর ইউপির পিচকামতাল গ্রামের নাজমুল মিয়ার সঙ্গে একই গ্রামের মুসলিমা আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ে পর তাদের সংসারে নুরতাজ (৫) ও নুসরাত জাহান নুরী (১৪ মাস) দুইটি কন্যা সন্তান জন্ম হয়।
ছোট মেয়ে নুসরাত জাহান নুরী জন্ম হওয়ার পর থেকে নাজমুল পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। স্বামীর পরকীয়ায় বাধা দিতে গিয়ে মুসলিমার সংসার চলে আসে কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদ নিত্যদিনের সঙ্গী। পরকীয়া প্রেমিকাকে গোপনে বিয়ে করে রূপগঞ্জ বরপা এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে বসবাস করতো নাজমুল। এ খবর পেয়ে মুসলিমা আক্তার দুই শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বরপা থেকে নাজমুলকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরিস্থিতিতে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় হয়, এক পর্যায়ে নাজমুল ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রীকে মারধর করে ঘুমন্ত শিশু কন্যা নুরসাত জাহান নুরীকে গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
(১১) আদাবরে চাঞ্চল্যকর শিশু সামিউল হত্যা, মা ও প্রেমিকের মৃত্যুদণ্ড
ঘটনাটি ২৩ জুন, ২০১০ এর। রাজধানীর আদাবরে পরকীয়ার বলি হয় শিশু খন্দকার সামিউল আজিম ওয়াফি (০৫)। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১০ বছর পর ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর শিশুটির মাসহ দুই জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই রায় দিয়েছিলেন।
মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন- শিশু সামিউলের মা আয়েশা হুমায়রা এশা ও এশার প্রেমিক শামসুজ্জামান আরিফ ওরফে বাক্কু (৪৩)।
সংশ্লিষ্ট ঘটনায় সামিউলের বাবা কে আর আজম বাদী হয়ে আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। ওই মামলার তথ্য অনুযায়ী, মা হুমায়রা ও শামসুজ্জামানের পরকীয়া দেখে ফেলায় ২০১০ সালের ২৩ জুন সামিউলকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। মামলাটি তদন্ত করে পরের বছর ২৫ অক্টোবর হুমায়রা ও শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়।
সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য
সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, নানা কারণে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরছে। এ কারণে অবিশ্বাস ও অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে, যা অনেক সময় নৃশংস খুনে রূপ নিচ্ছে। যার মধ্যে পড়ে নিষ্পাপ শিশুরাও বলি হয়ে যাচ্ছে!
এ বিষয়ে আরটিভি নিউজের সঙ্গে কথা হয় শিশু, কৈশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের। তিনি বলেন, আমি বলবো যে মানুষের সামাজিক দক্ষতার অভাব রয়েছে। যেখানে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের পছন্দের সঙ্গী বেচে নেওয়ার লিগ্যাল পদ্ধতি রয়েছে, সেক্ষেত্রে সামাজিক দক্ষতাকে উপেক্ষা করে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরকীয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে যেরকম সামাজিকভাবে বৈধ, তেমনিই ডিভোর্স বা তালাক সামাজিকভাবে বৈধ। তাহলে কেনো পরকীয়া জড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ! পরকীয়া এড়াতে অবশ্যই সামাজিক দক্ষতার প্রয়োগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে পরকীয়াকে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে পারেন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন আরটিভি নিউজকে বলেন, পরকীয়া সমাজের একটি ভয়ংকর ব্যাধি। এই সম্পর্কে জড়ানোর পর মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তখন নিজের সন্তানকেও শত্রু ভাবতে শুরু করে। এর পরই সন্তানকে খুন করে। তিনি বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বের হতে হবে। স্বামী ও স্ত্রীকে একে অপরের সময় দিতে হবে। নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান আরটিভি নিউজকে বলেন, পরকীয় একটি ভয়ংকর প্রতারণা। দেশে পরকীয়ার হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি দিন দিন সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। এ কারণেই কেউ কেউ নিজের সন্তানকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এমন ঘটনা প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়াও কিছু কিছু পরিবার মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বিত্তশালী কিংবা উচ্চ-বিলাসী ভালো চাকরিজীবী পাত্র খুঁজেন। এমন পাত্রদের অধিকাংশই বয়স্ক হয়ে থাকেন। যে কারণে অভিভাবকরা তুলনামূলক বেশি বয়সী পাত্রের সঙ্গে কম বয়সী মেয়ের বিয়ে দেন। এক্ষেত্রে বয়সের তুলনামূলক বিষয়টি বিবেচনা করা হয় না, ভেবে দেখা হয় না যে- স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ কেমন হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে দাম্পত্য জীবনে তারা কতোটা সুখী হতে পারবে। পরকীয়া জড়িয়ে যাওয়া স্ত্রীদের কারো কারো স্বামী প্রবাসে থাকায়, দূরত্বের কারণে তাদের একটি অংশ পরপুরুষে আসক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়াও স্বামী তুলনামূলক বেশি বয়সী হলে, ওই স্বামীর সঙ্গে অল্প বয়সী স্ত্রীরা সংসার করলেও অন্য তরুণ বা যুবক বয়সী পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায় নারীরা। তাই, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে অভিভাবকদেরই।
এই আইনজীবী আরও বলেন, আমাদের দেশে পরকীয়ার শাস্তি এবং পরিবারের ভরণপোষণের বিষয়টি অতোটা সুস্পষ্ট নয়। এছাড়াও আইনে পরকীয়ার যে শাস্তির বিধান রয়েছে তার পুরুষের জন্য, নারীদের জন্য না। যে কারণে নারীরা সহজেই পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। স্বামী এ কাজে বাধা প্রদান করলে উল্টো নারী নির্যাতনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হুমকি দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও দেশে পরকীয়ার শাস্তির ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের প্রচলন রয়েছে, পক্ষান্তরে অর্থদণ্ডের নেই। আর ক্ষোভের শিকার হয়ে কিংবা অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় পরকীয়ার বলি হচ্ছে নিষ্পাপ ও অসহায় শিশুরা।
কেএফ
মন্তব্য করুন