ঢাকামঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

সীমান্তে মানবপাচার : বন্দি ও নিখোঁজদের ফেরাতে স্বজনদের আহাজারি

নুরতাজুল মোস্তফা শাহীন শাহ

মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২ , ১২:৩৪ পিএম


loading/img

দেশের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ থেকে নীরবে চলছে মানবপাচার। ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় সংঘবদ্ধ দালাল চক্র টেকনাফকে মানবপাচারের সবচেয়ে উপযোগী রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। একসময় গভীর সাগর দিয়ে ট্রলারযোগে সরাসরি মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু এখন আগে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ডে। তারপর সুবিধা মতো পাচার করা হয় মালয়েশিয়ায়।

বিজ্ঞাপন

একমাস অনুসন্ধান করে সরেজমিন থেকে আরটিভি নিউজ এই তথ্য পেয়েছেন। তিন পর্বের অনুসন্ধানের আজকে দ্বিতীয় পর্ব।

সম্প্রতি দালালদের খপ্পরে পড়ে টেকনাফের বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে সকল বয়সীরা। এদের মধ্যে যুবকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিশোরের সংখ্যাও বাড়ছে। যার মধ্যে গুটিয়েক মানুষ মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারলেও বেশিরভাগ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্তে অনিশ্চিত অবস্থায় দিন পার করছে। কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না এমন সংখ্যাও অনেক।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, হদিস না পাওয়াদের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে আহাজারি চলছে। মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া অনেকের পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও স্ত্রী-সন্তানদের মাঝে স্বজন হারানোর বিলাপ আর আর্তনাদ চলছে। টেকনাফের বেশ কয়েকটি গ্রাম গত কয়েক দিন সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

মোহাম্মদ রিদুয়ান (১৬) লাতুরীখোলা গ্রামের আব্দুল মাবুদের ছেলে। হোয়াইক্যং উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায় মাসখানেক আগে। দালালের মিথ্যা তথ্য ও প্রলোভনে পড়ে রিদুয়ানের বাবা-মা। ভিটেমাটি বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা তুলে দেন দালালদের হাতে। কিন্তু এক মাস পার হলেও ছেলে মালয়েশিয়ায় পৌঁছায়নি। গত একমাস পর হঠাৎ ছেলে যোগাযোগ করে বাবা-মার সঙ্গে।

রিদুয়ানের বাবা-মা জানান, মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের ইরাদ্দি বুগলি শহরে একটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ট্রলারে থাকা মানুষদের উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। আবার অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। বর্তমানে রিদুয়ান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিছুটা সুস্থ হয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

বিজ্ঞাপন

ছেলের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে মা আসমা কেঁদে কেঁদে দিন পার করছেন। তিনি বলেন, সবকিছু তো গেল। অন্তত প্রাণের ধন ছেলেটাকে ফিরে পেলে জীবনটা বেঁচে যায় কোনো রকমে। এ সময় তিনি সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা কামনা করেন।

মো. জুবায়ের একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এক রোহিঙ্গা দম্পতি দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গমনের উদ্দেশে প্রথমে টেকনাফ ত্যাগ করেন। নাফ নদী হয়ে প্রথমে ইয়াংগুনের চামিলা নামক একটি এলাকার একটি ঘরে অবস্থান করে। সেখানে হয় বিপত্তি। দালালসহ ১২১ জন মিয়ানমার পুলিশের হাতে আটক হন। এ তথ্য জানান জুবায়েরের পিতা আমান উল্লাহ। ছেলেকে ফেরাতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন বলেও জানান তিনি।

রাজমিস্ত্রির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন যুবক মো. জসিম (২৪)। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী এ ব্যক্তি তিন বছর ও ১১ মাসের দুই সন্তান ও স্ত্রী জাহেদা বেগমকে নিয়ে তার সুখের সংসার। নিয়মিত কাজ পেতো না বলে ধার দেনা করে দালালদের হাতে মোটা অংকের টাকা তুলে দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। কিন্তু মিয়ানমারের চামিলা এলাকায় দালালদের আস্তানায় অন্যান্যদের সঙ্গে আটক হন জসীম। এক মাসের বেশি হয়ে গেছে সেখানে তিনি বন্দি।

এদিকে তার বাড়িতে চালডাল নেই। অনাহারে অর্ধহারে চলছে জাহেদার সংসার। জাহেদা বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে সুখের জন্য স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন তার স্বামী। কিন্তু পারলেন না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে সংসারে কঠিন মুহূর্ত পার করছেন তিনি। অবুঝ ছেলে দু’টিকে নিয়ে স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় তার সময় পার হয়। ধার-দেনা পরিশোধের জন্য বসতবাড়িও বিক্রি করতে হবে বলেও জানালেন ভাগ্য বিড়ম্বিত এই গৃহবধূ।

কানজরপাড়ার আক্তার হোসেনসহ ছয় কিশোরকে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে নাফ নদী পার হয়ে মিয়ানমারের চামিলায় নিয়ে আটকে রাখে একটি দালাল চক্র। সেখানে তাদের বন্দি রেখে দেড় লাখ টাকা করে দাবি করেন দালালেরা।

আক্তার হোসেনের ভাই জাগির হোসেন জানান, বখতারের ছেলে দালাল সাইমুম- আক্তারসহ আরাফাত, গিয়াস, কালু, করাচিপাড়ার মুফিজ ও সাইফুলকে নিয়ে মিয়ানমারের একটি চক্রের হাতে তুলে দেন। দালালেরা ছয়জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে মালয়েশিয়া যেতে হলে ৬ লাখ টাকা এবং বাড়ি ফিরতে চাইলে দেড় লাখ টাকা করে দাবি করে। অন্যথায় তাদের ফেরত দেয়া হবে না বলেও জানিয়ে দেয়। এখন নিরুপায় হয়ে অন্যদের মতো করে ধার-দেনা করে দেড় লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে দালালদের কাছে।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, হোয়াইক্যং ইউনিয়নে মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে অবৈধ পথে বিদেশে না যেতে নিয়মিত জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। তারপরেও দালালদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন অনেক মানুষ। ফলে এখানে আইনশৃংখলা বাহিনীর কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরি।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, মানবপাচারের বিষয়টি ইদানিং লক্ষ করছি। কয়েক দিন আগে দুইজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। নতুন করে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

টেকনাফস্থ বিজিবি’র (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ব্যাটালিয়ন-২ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়া পাচারেরের বিষয়ে তাদের কোনো তথ্য নেই। সঠিকভাবে তথ্য উপাত্ত পেলেই তাদের ফেরত আনতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |