• ঢাকা শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১
logo

‘দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনার জীবনে এত পরমায়ু সৃষ্টিকর্তা আমাকে কেন দিল?’

সৈয়দা মুনিরা ইসলাম

  ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৪:০৬

‘দুঃখের পরে সুখ আসে আর সুখের পরে দুঃখ’ এই বাক্যটি আমরা সবাই জানি ও বিশ্বাস করি। কিন্তু কখনও কখনও এর ব্যতিক্রমও ঘটে। এমনই একজন ব্যতিক্রম ব্যক্তির নাম অশীতিপর দুঃখী দাসী। ১২৪ বছর বয়সে পৌঁছেও সুখের দেখা পাননি তিনি; জীবনটা ভরা যার শুধু দুঃখ, কষ্ট, শোক আর বঞ্চনায়।

খুব ছোটবেলায় দুঃখী দাসীর বাবা-মা মারা যান। মামাবাড়িতে আশ্রয় মেলে দুঃখী দাসী ও তার ভাইয়ের। সেখানেই বেড়ে ওঠা। মামারাই বিয়ে দেন তার। তাফালিয়ায় স্বামীর বাড়িতে সংসারজীবন শুরু করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলে স্বামী ও জোয়ান ছেলেদের। তারপর অভাবে পরে ছোট এক খণ্ড জমি বিক্রি করতে গিয়ে তার এক টিপসইয়ে হারান স্বামীর ভিটাসহ সব জমিজমা। তারপর ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় দুঃখের ও সংগ্রামের নতুন উপাখ্যান। নানাবাড়িতে আশ্রিত থেকে, পরের বাড়িতে ধান ভেনে, মুড়ি ভেজে, শাক তুলে বিক্রি করে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করে যান। নিজের ঘর না থাকায় ছেলের বিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাখতে পারেননি। সে দূরে থাকে। নিয়মিত মায়ের কাছে আসতে পারে না। সেজন্য দুঃখী দাসীর মনে ভীষণ কষ্ট। পরে মেয়ে আরতির বিয়ে দেন এবং এরপর মেয়ে তার মাকে তাফালিয়া থেকে ভাদালিয়ায় নিজের সংসারে নিয়ে আসে।

এখন পর্যন্ত শতবর্ষী এই দুঃখী দাসী মেয়ে আরতি ও জামাই লক্ষ্মণের সংসারেই আছেন। মেয়ে জামাই, নাতি-নাতনি, পৌত্র-পৌত্রী সবাইকে অনেক ভালোবাসেন এবং স্নেহ করেন। কিন্তু নিজের একমাত্র ভাই আশুতোষ যে দেশ ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগে, দীর্ঘ সময় তার সাথে দেখা হয়নি, এই কষ্ট কাঁদায় তাকে। চোখের সামনে স্বামী সন্তান নিহত হওয়ার স্মৃতি মনে পড়লে তীব্ৰ মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েন। বর্তমানে বিধবা ভাতা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা পান না দুঃখী দাসী, জানিয়েছেন তার মেয়ে আরতি।

১৯৪৩ সালের মন্বন্তর দেখেছেন, দেখেছেন ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ। কালের সাক্ষী এই মানুষটি বর্তমানে বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। দুর্বল হয়ে গেছে শরীর। দু’বছর আগেও লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করতেন । যেতেন এ বাড়ি-ও বাড়ি। কিন্তু এখন আর চলাফেরা করতে পারেন না। শুয়ে-বসে দিন কাটে তার। দৈনন্দিন কাজ যেমন গোসল, পোশাক পরিধান, বাথরুমে যাওয়া নিজে করতে পারেন না। এগুলো সব করে দেন তার মেয়ে আরতি। স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। তাই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা খুব একটা মনে করতে পারেন না। বয়সজনিত শারীরিক সীমাবদ্ধতা ছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য আর কোনো অসুখ নেই তার। স্বাভাবিক সব খাবার খেতে পারেন। তবে চা-রুটি বেশি পছন্দ। কিন্তু চা খেলে ঘুম হয় না বলে বার বার চা খেতে দেয় না মেয়ে।

বাড়িতে অতিথি গেলে খুব খুশি হন দুঃখী দাসী। হাসিমুখে গল্প করেন। অতিথি আপ্যায়নের জন্য মেয়েকে তাড়া দিতে থাকেন। অতিথি বিদায়ের সময় মাথায় হাত দিয়ে মন ভরে আশীর্বাদ করে দেন ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দুঃখী দাসীর মেয়ে আরতির বয়স ছিল ৫-৬ বছর। তিনিও সেই সময়ের কথা মনে করতে পারেন। বলেন, যে মুহূর্তে পাক বাহিনী ধান খেতে লুকিয়ে থাকা আমার বাবা-ভাইদের বের করে মেরে ফেলে তখন আমার মা অজ্ঞান হয়ে যায়। আরতি বলেন, আমার মায়ের বুক ভরা কেবল দুঃখ। আমার মায়ের নাম যেমন দুঃখী তার জীবনটাও তেমনই দুঃখে ভরা।

দুঃখী দাসীরা মোট দশ ভাই-বোন ছিলেন। ৯ ভাই এক বোনের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন মাত্র এক ভাই ও তিনি। মায়ের জীবনের এই দুঃখ কষ্ট কাঁদায় মেয়েকেও। তাই ক্ষোভ নিয়ে তিরি বলেন, আমার মা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী সন্তান হারিয়েছে। আমি বাবাকে ও ভাইদের হারিয়েছি। কিন্তু তার বিনিময়ে আমার মা কী পেয়েছে? মা-মেয়ে আলাপকালে মা প্রায় বলে, সৃষ্টিকর্তা আমার এত পরমায়ু কেন দিলেন! আমার সব কেড়ে নিয়ে আমাকে এতদিন কেন বাঁচিয়ে রাখলেন?
দুঃখী দাসীর স্বজনরাও বলেন এত কষ্ট করেছেন তিনি, স্বামী সন্তান হারিয়েছেন, বসতভিটা হারিয়েছেন কিন্তু বিনিময়ে আজীবন দুঃখ ছাড়া কী পেলেন! বরং দুঃখী দাসীর পরবর্তী প্রজন্মকেও ভুগতে হচ্ছে নানান সমস্যায়। সরকারের খাস জমিতে অস্থায়ী আবাস তাদের। পাচ্ছেন না সন্তানদের জন্ম নিবন্ধন করার সুযোগও।

তাফালিয়া ও ভাদালিয়া এলাকার স্থানীয়রা অবশ্য দুঃখী দাসীকে কালির মা নামেই চেনেন। কালির মা নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে দুঃখী দাসীর আসল নাম।

যারা কাছে থেকে তাকে দেখেছেন তারা বললেন দুঃখী দাসীর সংগ্রামী জীবনের কথা। স্বামী সন্তান হারানোর কথা। তার ত্যাগের কথা বিবেচনা করে এই প্রবীণ মানুষটির যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত ছিল, সেগুলো না পাওয়ার কথা। এক জীবনে তিনি যা হারিয়েছেন, সে তুলনায় কিছুই পাননি তিনি। তাই তো জীবনের প্রিয় সম্পদগুলো হারিয়ে, এত এত বঞ্চনার শিকার হয়ে জীবন সায়াহ্নে এসে ১২৪ বছর বয়সী দুঃখী দাসী বিধাতার কাছে জানতে চান, সৃষ্টিকর্তা তাকে এত পরমায়ু কেন দিলেন? এত দুঃখ কষ্ট নিয়ে এত বড় জীবনযাপন করার সার্থকতা কোথায়!

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়